Saturday 5 August 2017

Chanti Path Chapter 1 শ্রীশ্রীদুর্গাসপ্তশতী প্রথম অধ্যায়

শ্রী চণ্ডী মাহাত্য
।। শ্রীদুর্গাকে প্রণাম ।।
শ্রীশ্রীদুর্গাসপ্তশতী
প্রথম অধ্যায়
মেধা ঋষি কর্তৃক রাজা সুরথ ও সমাধিকে ভগবতীর মহিমা বর্ণন প্রসঙ্গে মধুকৈটভ বধ সংবাদ
বিনিয়োগ :-
এই প্রথম চরিত্রের ব্রহ্মা ঋষি, মহাকালী দেবতা, গায়ত্রী ছন্দ, নন্দা শক্তি, রক্তদন্তিকা বীজ, অগ্নি তত্ত্ব এবং ঋগ্বেদ স্বরূপ। শ্রীমহাকালী দেবতার প্রীতির জন্য প্রথম চরিত্রের জপে বিনিয়োগ করা হয়।
ধ্যান :-
ভগবান বিষ্ণু যোগনিদ্রায় থাকার সময় মধু এবং কৈটভকে বধের জন্য কমলজন্মা ব্রহ্মা যাঁকে স্তব করেছিলেন, সেই মহাকালী দেবীকে আমি সেবা(উপাসনা) করছি। তিনি নিজের দশ হাতে খড়্গ, চক্র, গদা, বাণ, ধনুষ, পরিঘ, শূল, ভুশুণ্ডি, নরমুণ্ড ও শঙ্খ ধারণ করেন। তাঁর তিনটী নেত্র। তিনি সর্বাঙ্গে দিব্য আভরণে ভূষিতা। তাঁর শরীরের জ্যোতি নীলকান্তমণির মত। তার দশটী মুখ ও দশটি পা ।।১।।
ঔং চণ্ডীকা দেবী কে প্রণাম
মহর্ষি মার্কেণ্ডেয় বললেন - ।।১।।
সূর্যপুত্র সাবর্ণি, যিনি অষ্টম মনু বলে কথিত, তাঁর উৎপত্তি(জন্মকাহিনী) কথা বিস্তারিতভাবে বলছি, শোনো ।।২।।
সূর্যতনয় মহাভাগ (মহাঐশ্বর্যশালী) সাবর্ণি ভগবতী মহামায়ার অনুগ্রহে যে ভাবে মন্বন্তরাধিপতি হয়েছিলেন, সেই প্রসঙ্গ শোনাচ্ছি ।।৩।।
পূর্বকালে স্বারোচিষ মন্বন্তরে সুরথ নামে এক রাজা ছিলেন, যিনি চৈত্রবংশে জন্মেছিলেন, তিনি সমগ্র ভূমণ্ডলের অধিপতি হয়েছিলেন ।।৪।।
তাঁর প্রজাদের তিনি নিজ ঔরসজাত পুত্রের মত নীতিশাস্ত্রমতে পালন করতেন; তবুও সেই সময় কোলাবিধ্বংসী নামক ক্ষত্রিয় তাঁর শত্রু হয়েছিল ।।৫।।
সুরথরাজার দণ্ডনীতি বড়ই প্রবল ছিল। শত্রুদের সাথে তাঁর যুদ্ধ হয়েছিল। কোলাবিধ্বংসীরা যদিও সংখ্যায় কম ছিল তবুও রাজা সুরথ যুদ্ধে পরাস্ত হয়েছিলেন ।।৬।।
তখন তিনি রণভুমি থেকে প্রত্যাগমন করে এসে কেবলমাত্র নিজের দেশের রাজা হয়ে থেকে গেলেন (সমগ্র পৃথিবী থেকে তাঁর অধিকার চলে যেতে থাকল), কিন্তু সেখানেও সেই প্রবল শত্রুরা সেই সময় এসে মহাভাগ রাজা সুরথকে আক্রমণ করল ।।৭।।
রাজার শক্তি কমে যাচ্ছিল; তার ফলে তাঁর দুষ্ট, বলবান এবং দুরাত্মা মন্ত্রীগণ সেই রাজধানীতেও রাজকীয় সৈন্যসামন্ত ও কোষাগার অধিকার করে নিল ।।৮।।
সুরথের প্রভুত্ব নষ্ট হয়ে যাওয়াতে তিনি মৃগয়ার উদ্দেশ্যে ঘোড়ায় চড়ে একলাই এক গভীর অরণ্যে গমন করলেন ।।৯।।
সেখানে তিনি দ্বিজবর মধা ঋষির আশ্রম দেখতে পেলেন, সেখানে হিংস্র জন্তুরাও নিজেদের স্বাভাবিক হিংসাবৃত্তি ত্যাগ করে পরস্পর শান্তভাবে বাস করত। মুনির অনেক শিষ্য সেই আশ্রমের শোভাবর্দ্বন করত ।।১০।।
সেখানে যাওয়ার পর তিনি মুনির দ্বারা সমাদুত হয়ে সেই মুনিবরের আশ্রমে ইতস্ততঃ ঘোরাফেরা করে কিছু সময় কাটালেন ।।১১।।
সেখানে মমতাভিভূত চিত্তে তিনি চিন্তা করতে লাগলেন - অতীতে আমার পূর্বপুরুষরা যে নগর সুরক্ষিত রেখেছিলেন, সেই নগর আজ আমার দ্বারা পরিত্যক্ত। আমার দুরাচারী ভৃত্যবর্গ সেই নগর ধর্মানুসারে বক্ষা করেছে কিনা জানি না, সর্বদা মদস্রবী ও মহাবল, আমার প্রধান হস্তী এখন শত্রুদের অধীন হয়ে কেমন সব ভোগ করছে। যে সব লোকেরা আমার অনুগ্রহ, বেতন, ভোজ্যদ্রব্যাদি পেয়ে সর্বদা আমার অনুগত ছিল, তারা নিশ্চয়ই এখন অন্য রাজাদের দাসত্ব করছে। বহুকষ্টে সঞ্চিত আমার সেই ধনরাশি ওই সব অমিতব্যয়ী আমাত্যদের দ্বারা নিয়ত ক্ষয় হতে হতে নিঃশেষ হয়ে যাবে। রাজা সুরথ সর্বদাই এই সমস্ত ঘটনা এবং অন্যান্য দুশ্চিন্তা করতেন। একদিন তিনি সেই দ্বিজবর মেধা মুনির আশ্রমের কাছে এক বৈশ্যকে দেখতে পেলেন এবং তাকে জিজ্ঞাসা করলেন - 'মহাশয়, তুমি কে? তুমি এখানে কেন এসেছ? তোমাকে যেন শোকাকুল ও মানসিক বেদনাযুক্ত বলে মনে হচ্ছে? রাজা সুরথের এই প্রীতিপূর্ণ সম্ভাষণে বিনয়াবনতভাবে সেই বৈশ্য রাজাকে প্রণাম করে প্রত্যুত্তরে বললেন - ।।১২-১৯।।
বৈশ্য বললেন - ।।২০।।
হে রাজন্! ধনবান বংশে জাত আমি এক বৈশ্য। আমার নাম সমাধি ।।২১।।
আমার দুষ্ট স্ত্রীপুত্রেরা ধনলোভে আমাকে বিতাড়িত করেছে। বর্তমানে আমি ধনসম্পত্তি ও স্ত্রীপুত্রাদির দ্বারা পরিত্যক্ত। আমার বিশ্বস্ত আত্মীয়স্বজনেরা আমার ধনসম্পত্তি আত্মসাৎ করে আমাকে পরিত্যাগ করেছে, এইজন্য দুঃখিত মনে আমি বনে চলে এসেছি। এখানে এসে আমি জানতেও পারছি না যে আমার স্ত্রীপুত্র এবং আত্মীয়-বন্ধুরা কুশলে আছে কিনা? বাড়ীতে এখন তারা কুশলে আছে না কষ্টে আছে কে জানে? ।।২২-২৪।।
আমার ছেলেরা কেমন আছে? তারা কি সদাচারী আছে না দুরাচারী হয়ে গেছে? ।।২৫।।
রাজা জিজ্ঞাসা করলেন - ।।২৬।।
যে সব লোভী স্ত্রীপুত্রগণ অর্থের লোভে তোমাকে ঘরছাড়া করেছে, তাদের জন্য তোমার মন এত স্নেহাসক্ত কেন? ।।২৭-২৮।।
বৈশ্য (সমাধি) বললেন - ।।২৯।।
আমার সম্বন্ধে আপনি যা বলছেন তা সবই ঠিক ।।৩০।।
কিন্তু কি করব, আমার মন তো নিষ্ঠুর হতে পারছে না। যারা অর্থের লোভে পিতৃস্নেহ, পতিপ্রেম ও স্বজনপ্রীতি জলাঞ্জলি দিয়ে আমাকে বহিস্কৃত করেছে তাদের প্রতিই আমার মন অনুরক্ত হচ্ছে। হে মহামতি! গুণহীন (স্নেহহীন) বন্ধুদের প্রতিও যে আমার মন এই রকম মমতাযুক্ত হচ্ছে, এর কারণ কি? আমি তো বুঝেও বুঝতে পারছি না। তাদের জন্য আমার দীর্ঘশ্বাস পড়ছে এবং অত্যন্ত দুশ্চিন্তা হচ্ছে ।।৩১-৩৩।।
ওরা প্রীতিহীন, তবুও যে ওদের প্রতি আমি নির্দয় হতে পারছি না। আমি কি করব? ।।৩৪।।
মার্কেণ্ডেয় মুনি বললেন - ।।৩৫।।
হে ব্রহ্মন্! তখন রাজশ্রেষ্ঠ সুরথ এবং সেই সমাধি নামক বৈশ্য দুজনে একসাথে মেধা ঋষির কাছে গিয়ে যথাযোগ্য বিনীত প্রণাম করে তাঁর সামনে বসলেন। তারপর সেই বৈশ্য এবং রাজা কিছু কথাবার্তা শুরু করলেন ।।৩৬-৩৮।।
রাজা বললেন - ।।৩৯।।
হে ভগবন্! আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করি। অনুগ্রহ করে তার উত্তর আমাকে বলুন ।।৪০।।
আমার মন আমার নিজের বশীভূত না থাকায় এই প্রশ্ন সর্বদাই আমাকে দুঃখ দিচ্ছে। যে রাজ্য আমার হাতের বাহিরে চলে গেছে সেই রাজ্যের প্রতি এবং তার সব কিছুর প্রতি আমার মমতা বদ্ধ হয়ে রয়েছে ।।৪১।।
হে মুনিসত্তম! সেই রাজ্য যে আমার আর নেই তা জানা সত্ত্বেও অজ্ঞানীর মত সেই রাজা এবং রাজ্যের বিভিন্ন বস্তুর জন্য আমার মন বিষাদগ্রস্ত, এর কারণ কি? এখানে এই বৈশ্যও স্ত্রীপুত্রদের দ্বারা বাড়ী থেকে বিতাড়িত, অপমানিত হয়ে এসেছেন। পুত্র, স্ত্রী এবং ভৃত্যেরা একে ছেড়ে গেছে ।।৪২।।
স্বজনরাও তাকে পরিত্যাগ করেছে, তবুও তাদের প্রতি এই বৈশ্য অতিশয় আসক্ত। এই পরিস্থিতিতে ইনি এবং আমি দুজনেই অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে রয়েছি ।।৪৩।।
যেখানে যে ব্যাপারে আমরা প্রত্যক্ষভাবে দোষ দেখতে পাচ্ছি, সেই বিষয়ের প্রতিও আমাদের মনে মমতাজনিত আকর্ষণ জন্মাচ্ছে। হে মহাভাগ! আমরা দুজনেই বুদ্ধিমান তথাপিও আমাদের মনে যে মোহ উৎপন্ন হয়েছে, এটা কেন? বিবেকহীন মানুষের মত এই রকম মূঢ়তা, আমার এবং এর মধ্যেও কেন? ।।৪৪-৪৫।।
ঋষি বললেন - ।।৪৬।।
হে মহামতে! সব প্রাণীরই রূপ, রস প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ে জ্ঞান আছে ।।৪৭।।
এইরকম বিষয়সমূহও প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা, কোনও প্রাণী দিনের বেলায় দেখতে পায় না, তাই সে রূপএর বিষয়ে দিনের বেলায় অজ্ঞান, আবার কোনও প্রাণী রাতের বেলা দেখতে পায় না, সে রাত্রিবেলা রূপের বিষয়ে অজ্ঞান ।।৪৮।।
আবার কিছু প্রাণী আছে যারা দিনে ও রাত্রে একই রকমভাবে দেখতে পায়, একথা সত্যি যে মানুষ জ্ঞানবান্ কিন্তু মানুষই কেবল এরকম নয় ।।৪৯।।
পশু, পাখী, মৃগ ইত্যাদি সব প্রাণীরই বিষয়জ্ঞান আছে। মানুষের জ্ঞানও পশুপাখীদের বিষয়জ্ঞানের মত ।।৫০।।
আবার মানুষেরও যেরকম বিষয়জ্ঞান পশুপাখীদেরও তেমনই। এই বিষয়জ্ঞান তথা অন্যান্য ব্যাপারেও উভয়েরই জ্ঞান সমান সমান। দেখ, জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও পাখীরা নিজে ক্ষুধার্থ হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র মোহের বশে নিজের বাচ্চাদের মুখে খাবারের দানা দিয়ে দেয়। হে নরশ্রেষ্ঠ! দেখলেই বুঝতে পারবে যে মানুষ জ্ঞানী হয়েও শুধুমাত্র লোভের বশে প্রত্যুপকারের আশায় পুত্রসন্তানদের কামনা করে? যদিও এদের কারুর মধ্যেই জ্ঞানের অভাব নেই তবুও সংসারের স্থিতিকারিণী (জন্ম-মৃত্যুপরম্পরা) ভগবতী মহামায়ার প্রভাবে এরা সকলে মমতারূপ আবর্তযুক্ত মোহরূপ গর্তে পড়ে আছে। অতএব এই ব্যাপারে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। জগৎপতি ভগবান বিষ্ণুর যোগনিদ্রারূপা যে ভগবতী মহামায়া, তাঁর দ্বারাই এই জগৎ মোহিত হয়ে রয়েছে। সেই ভগবতী দেবী মহামায়া জ্ঞানীদের চিত্তকে বলপূর্বক আকর্ষণ করে মোহাবৃত করেন। তিনিই এই সম্পূর্ণ চরাচর জগৎ সৃষ্টি করেন, আবার তিনিই প্রসন্না হলে মানুষকে মুক্তিলাভের জন্য বরদান করেন। তিনিই সংসার বন্ধন ও মোক্ষের কারণস্বরূপা পরাবিদ্যা ও সনাতনী (অন্তবিহীনা) দেবী তথা ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরাদি সকল ঈশ্বরের ঈশ্বরী ।।৫১-৫৮।।
রাজা সুরথ জিজ্ঞাসা করলেন - ।।৫৯।।
হে ভগবন্! যাঁকে আপনি মহামায়া বলছেন, সেই দেবী কে? ব্রহ্মন্! তিনি কিরূপে আবির্ভূতা হয়েছেন? তাঁর চরিত্র কিরকম? হে ব্রহ্মবেত্তাগণের মধ্যে শ্রষ্ঠ! সেই দেবীর যেরূপ স্বভাব, তাঁর যা স্বরূপ এবং তিনি যেভাবে উৎপন্না হয়েছেন, সেই সবকিছু আপনার শ্রীমুখ থেকে আমরা শুনতে ইচ্ছা করি ।।৬০-৬২।।
মেধা ঋষি বললেন - ।।৬৩।।
হে রাজন্! প্রকৃতপক্ষে তো তিনি নিত্যস্বরূপাই। সমগ্র জগৎপ্রপঞ্চ তাঁরই মুর্তিস্বরূপ। তিনি সর্বব্যাপিনী। তথাপি তাঁর আবির্ভাব বহুপ্রকারে হয়ে থাকে। সেইসব কাহিনী আমার কাছে শোন। তিনি যদিও নিত্যা এবং জন্মমৃত্যুরহিতা, তবুও দেবতাদের কার্যসিদ্ধির জন্য যখন তিনি প্রকট হন তখন লোকে তাঁকে উৎপন্না বলে থাকে। কল্পান্তে (প্রলয়কালে) সমগ্র জগৎ যখন একার্ণব জলে নিমগ্ন হল আর সকলের প্রভু ভগবান বিষ্ণু শেষনাগকে শয্যারূপে বিস্তৃত করে যোগনিদ্রাকে আশ্রয় করে শুয়ে ছিলেন, সেই সময় তাঁর কর্ণমল থেকে মধু ও কৈটভনামে দুই ভয়ঙ্কর অসুর উৎপন্ন হল। তারা দুজনে মিলে ব্রহ্মাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। ভগবান বিষ্ণুর নাভিকমলে বিরাজমান প্রজাপতি ব্রহ্মা সেই দুই ভীষণ অসুরকে প্রত্যক্ষ দেখে এবং ভগবান বিষ্ণুকে নিদ্রিত দেখে, একাগ্রচিত্তে ভগবান বিষ্ণুকে জাগাবার উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁর চোখে নিবাসিনী যোগনিদ্রার স্তব করতে লাগলেন। এই বিশ্বের জগদীশ্বরী, জগদ্ধাত্রী, স্থিতিসংহারকারিণী এবং তেজঃস্বরূপ ভগবান বিষ্ণুর অনুপম শক্তি, সেই ভগবতী নিদ্রাদেবীকে ভগবান ব্রহ্মা স্তুতি করতে লাগলেন ।।৬৪-৭১।।
ব্রহ্মা বললেন - ।।৭২।।
দেবী! তুমি স্বাহা, তুমি স্বধা এবং তুমিই বষট্কার স্বরও তোমারই স্বরূপ। তুমিই জীবনদায়িনী সুধা। নিত্য অক্ষর প্রণবের অকার, উকার, মকার - এই তিনমাত্রারূপে তুমিই স্থিত, আবার এই তিন মাত্রা ছাড়া বিন্দুরূপা যে নিত্য অর্দ্ধমাত্রা - যাকে বিশেষরূপে আলাদাভাবে উচ্চারণ করা যায় না, তাও তুমিই। দেবি! তুমিই সন্ধ্যা, সাবিত্রী তথা পরম জননী। দেবি! তুমিই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ধারণ করে আছ। তোমার থেকেই এই জগতের সৃষ্টি হয়। তোমার দ্বারাই এই জগতের পালন হয় এবং সর্বদা প্রলয়কালে তুমিই এর সংহার কর। জগন্ময়ী দেবী! এই জগতের সৃষ্টিকালে তুমি সৃষ্টিরূপা, পালনকালে স্থিতিরূপা এবং প্রলয়কালে সংহারশক্তিরূপা। তুমিই মহাবিদ্যা, মহামায়া, মহামেধা, মহাস্মৃতি, মহামোহরূপা, মহাদেবী ও মহাসুরী। তুমিই সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনগুণের সৃষ্টিকারিণী সর্বময়ী প্রকৃতি। ভয়ঙ্কর কালরাত্রি, মহারাত্রি ও মোহরাত্রিও তুমিই। তুমিই শ্রী, তুমিই ঈশ্বরী, তুমিই হ্রী এবং তুমি নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি। লজ্জা, পুষ্টি, তুষ্টি, শান্তি ও ক্ষমাও তুমিই। তুমি খড়্গধারিণী, শূলধারিণী, ঘোররূপা, তথা গদা, চক্র, শঙ্খ ও ধুনর্ধারিণী। বাণ, ভুশুণ্ডী ও পরিঘা - এসবও তোমার অস্ত্র। তুমি সৌম্যা ও সৌম্যতরা - শুধু তাই নয়, যত কিছু সৌম্য এবং সুন্দর পদার্থ আছে, সেই সবের থেকেও তুমি অত্যধিক সুন্দরী, পর ও অপর - সবের উপরে পরমেশ্বরী তুমিই। হে বিশ্বরূপিণী, যে-কোনও স্থানে যাহা কিছু চেতন বা জড় বস্তু অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতে হইবে সেই সকলের যে শক্তি, তাহা তুমিই। সুতরাং কিরূপে তোমার স্তব করিব? (বিশ্বপ্রপঞ্চে তুমি ভিন্ন যখন আর কিছুই নাই, তখন তোমার স্তব কিরূপে সম্ভব?)। যেই ভগবান এই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও পালন করেন, সেই ভগবানকেও যখন তুমি নিদ্রাবিষ্ট করে রেখেছ, তখন কে তোমার স্তব করতে সমর্থ? আমাকে, ভগবান বিষ্ণুকে ও ভগবান রুদ্রকেও তুমিই শরীর গ্রহণ করিয়েছ; কাজেই তোমার স্তুতি করার মত শক্তি কার আছে? হে দেবি! তুমি তো নিজের এই উদর প্রভাবের দ্বারাই প্রশংসিত। এই যে দুই দুর্জয় অসুর মধু ও কৈটভ এদের তুমি মোহগ্রস্ত করে দাও এবং জগদীশ্বর ভগবান বিষ্ণুকে শীগগিরই জাগরিত করে দাও। সঙ্গে সঙ্গে এই মহাসুরকে বধ করবার জন্য তাঁর প্রবৃত্তি উৎপাদন কর ।।৭৩-৮৭।।
মেধা ঋষি বললেন - ।।৮৮।।
ব্রহ্মা যখন মধু আর কৈটভকে বধ করবার উদ্দেশ্যে ভগবান বিষ্ণুকে যোগনিদ্রা থেকে জাগাবার জন্য তমোগুণের অধিষ্ঠাত্রী দেবী যোগনিদ্রার এই রকম স্তুতি করলেন, তখন সেই দেবী যোগনিদ্রা ভগবান বিষ্ণুর চোখ, মুখ, নাক, বাহু, হৃদয় এবং বক্ষঃস্থল থেকে নিগত হয়ে অব্যক্ত জন্মা ব্রহ্মার দৃষ্টিগোচর হলেন। যোগনিদ্রা ভেঙ্গে যাওয়ার পর জগন্নাথ ভগবান জনার্দন একীভূত মহাসমুদ্রে অবস্থিত অনন্তশয়ান থেকে জেগে উঠলেন। গাত্রোত্থান করে তিনি ওই দুই অসুরকে দেখলেন। তারা, সেই দুরাত্মা, অতি বলবান ও মহাবিক্রমশালী ক্রোধে আরক্ত নয়নে ব্রহ্মাকে ভক্ষণের উদ্যোগ করছিল। অতঃপর ভগবান শ্রীহরি শয্যা ছেড়ে উঠে ওই দুই অসুরের সাথে পাঁচ হাজার বছর ধরে বাহুযুদ্ধ করলেন, ওরা দুজনও অত্যন্ত বলদর্পিত হয়েছিল। এদিকে দেবী মহামায়াও তাদের বিমোহিত করে রেখেছিলেন; ফলে তারা ভগবান বিষ্ণুকে বলল - 'আমরা তোমার বীরত্বে সন্তুষ্ট হয়েছি, তুমি আমাদের কাছে বর প্রার্থনা কর। ' ।।৮৯-৯৫।।
শ্রীভগবান বললেন - ।।৯৬।।
তোমরা দুজনে যদি আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে থাক, তবে তোমরা আমার হাতে বধ্য হও। ব্যস্, এইই আমার একান্ত অভিপ্রায়। অন্য বরের আর কি প্রয়োজন? ।।৯৭-৯৮।।
মেধা ঋষি বললেন - ।।৯৯।।
এইভাবে প্রবঞ্চিত হয়ে যখন তারা সমস্ত জগৎ জলমগ্ন দেখলো, তখন কমলনয়ন ভগবানকে বলল - পৃথিবীর যে জায়গাটা জলমগ্ন হয়নি যেখানে শুকনো জায়গা আছে, সেইস্থানে আমাদের বধ কর ।।১০০-১০১।।
মেধা ঋষি বললেন - ।।১০২।।
শঙ্খ, চক্র ও গদাধারী ভগবান বিষ্ণু 'তাই হোক' বলে ওদের দুজনের মাথা দুটি নিজের ঊরুর ওপর রেখে চক্র দিয়ে ছেদন করলেন। এইভাবে এই দেবী মহামায়া ব্রহ্মা কর্তৃক সংস্তুতা হয়ে স্বয়ং আবির্ভূতা হয়েছিলেন। আমি আবার তোমাদের কাছে এই দেবীর মহিমা বা আবির্ভাবের বিষয় বর্ণনা করছি, শোন ।।১০০-১০৪।।
শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণে সাবর্ণিকমন্বন্তরে দেবীমাহাত্ম্য প্রসঙ্গে মধুকৈটভবধনামক প্রথম অধ্যায় সম্পূর্ণ হল ।। ১ ।।

No comments:

Post a Comment