Friday 7 October 2016

Kaatyayani কাত্যায়নী মায়ের কথা

কাত্যায়নী
চন্দ্রহাসোজ্জ্বলকরা শার্দূলবরবাহনা।
কাত্যায়নী শুভং দদ্যাদ্দেবী দানবঘাতিনী।।
নবদুর্গার ষষ্ঠ রূপ কাত্যায়নী। নবরাত্রি উৎসবের ষষ্ঠ দিনে তাঁর পূজা করা হয়। তিনি আজ্ঞা চক্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। প্রাচীন কিংবদন্তি অনুযায়ী, কাত্যবংশীয় ঋষি কাত্যায়ন দেবী দুর্গাকে কন্যারূপে লাভ করার জন্য তপস্যা করেছিলেন। তাঁর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে দুর্গা কাত্যায়নের কন্যা রূপে জন্মগ্রহণ করে ‘কাত্যায়নী’ নামে পরিচিতা হন। অন্য মতে, ঋষি কাত্যায়ন প্রথম দুর্গাকে পূজা করেছিলেন বলে তাঁর নাম হয় ‘কাত্যায়নী’।
দেবী কাত্যায়নী চতুর্ভুজা–তাঁর ডানদিকের দুটি হাত বর ও অভয়মুদ্রা প্রদর্শন করে, বাঁ দিকের দুই হাতে পদ্ম ও খড়্গ। দেবী সিংহবাহিনী। তাঁর গায়ের রং সোনার মতো উজ্জ্বল। তন্ত্রসার-এর ধ্যানমন্ত্রে তাঁকে বর্ণনা করা হয়েছে দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী রূপে। আবার হরিবংশ গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি অষ্টাদশভুজা।
পতঞ্জলির মহাভাষ্য ও কৃষ্ণযজুর্বেদীয় তৈত্তিরীয় আরণ্যক-এ কাত্যায়নীর উল্লেখ রয়েছে। তাঁর কাহিনি বর্ণিত হয়েছে মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এর অন্তর্গত শ্রীশ্রীচণ্ডী, দেবীভাগবত পুরাণ, কালিকা পুরাণ ও বামন পুরাণ-এ। এই কাহিনিটিই দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধের কাহিনি। কাত্যায়নীই দুর্গা। একটি মতে বলে, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীর দিন দেবী কাত্যায়নীর জন্ম। তারপর শুক্লা সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর দিন ঋষি কাত্যায়নের পূজা গ্রহণ করে দশমীর দিন তিনি মহিষাসুর বধ করেছিলেন।

দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী কাত্যায়নী
দেবী কাত্যায়নীর পূজা করলে ভক্ত ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ–এই চার ফল লাভ করে; তার সমস্ত রোগ-শোক-ভয় দূর হয়; দূর হয় জন্ম-জন্মান্তরের পাপও। ভাগবত পুরাণ-এ আছে, বৃন্দাবনের গোপীগণ কৃষ্ণকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য সারা মাঘ মাস জুড়ে কাত্যায়নী ব্রত পালন করেছিলেন। তাই মনোমত স্বামী প্রার্থনায় এক মাস ধরে কাত্যায়নী ব্রত পালনেরও প্রথা রয়েছে।
কাশীর আত্মাবীরেশ্বর মন্দিরের গর্ভগৃহের একটি কুলুঙ্গিতে দেবী কাত্যায়নীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত। এটি অষ্টভূজা মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি। মূর্তিটি কষ্টিপাথরে নির্মিত, উচ্চতা এক হাত। উল্লেখ্য, স্বামী বিবেকানন্দের মা ভুবনেশ্বরী দেবী এই আত্মাবীরেশ্বর মন্দিরে মানত করেই স্বামীজিকে পুত্ররূপে লাভ করেছিলেন। আত্মাবীরেশ্বর শিবই দেবী কাত্যায়নীর ভৈরব। শারদীয়া ও বাসন্তী নবরাত্রির ষষ্ঠ দিনে এখানে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়।
কাত্যায়নী :--
____________
সতীর মরদেহ মহাদেবের স্কন্ধে,তা খন্ড খন্ড করে ভাগ করলেন বিষ্ণু নিজ সুদর্শনচক্র দিয়ে | বিভিন্ন স্থানে সতীর দেহ একান্নটি দেহাংশ ছড়িয়ে পড়ল | সৃষ্টি হল একান্নটি মহাপীঠ | বৃন্দাবন এক মহাপীঠ | দেবী সেখানে বিরাজিতা কাত্যায়নীরূপে--নবদুর্গার ষষ্ঠ রূপ | তাঁর একটি কার্য অনন্যসাধারণ,সেটি হল সুদুর্লভ কৃষ্ণভক্তিদান | 'চন্ডী'তে দেবীর সুখদা ও মোক্ষদা--দুটি স্বরূপের কথা জানা যায় | সুরথ রাজাকে দিলেন সুখ,সমাধি বৈশ্যকে দিলেন মোক্ষ | কাত্যায়নীরূপে দেবী ভক্তিদান করেন |
ভক্তি--ধন অতীব দুষ্প্রাপ্য বস্তু | এটি সাধনলব্ধ নয় | কোনো সাধনাতেই ভক্তি-সম্পত্তি লাভ করা যায় না | এটি একমাত্র কৃপালব্ধ সামগ্রী | কাত্যায়নীরূপিণী যোগমায়ার করুণায় তা লাভ হয় | তবে যাঁরা সুখ ও মোক্ষকে একান্তভাবে তুচ্ছ করতে পারে,যাঁদের কৃষ্ণসেবা ছাড়া আর কিছুই কাম্য নেই--তাঁদের দেবী দান করেন ভক্তি--প্রেমরূপ মহাসম্পদ |
ব্রজের গোপবালারা নন্দ-নন্দনকে পতিরূপে পাবার জন্য প্রার্থনা করেছিলেন কাত্যায়নী দেবীর কাছে | তাঁদের প্রার্থনার মন্ত্র ভাগবতে দৃষ্ট হয় :--
"কাত্যায়নী ! মহামায়ে ! মহাযোগিন্যধিশ্বরী ! নন্দগোপসুতে দেবী ! পতিং মে কুরু তে নম: ||"
কাত্যাযনীর ধ্যান :---
_____________
 "গরুড়ৎপলসন্নিভাং মণিময়কুণ্ডলমন্ডিতাম | নৌমি ভাববিলোচনাং মহিষত্তমাঙ্গনিষেদুষিম || শংখচক্রকৃপণখেটকবাণ কার্মুকশূলকম | তর্জনীমপি বিভ্রতিং নিজবাহুভি: শশীশেখরাম ||
মরকতমণিরতুল্যবর্ণা(হরিদ্বর্ণ),মণিময়কুণ্ডলশোভিতা,ভাবপূর্ণনেত্রাবিশিষ্টা,মহিষমস্তকস্থা(কাত্যায়নীকে নমস্কার করি | যিনি শংখ,চক্র,অসি,খেটক(যষ্ঠী),বাণ,ধনু,শূল ও তর্জনী ধারণ করে আছেন,যাঁর মস্তকে চন্দ্র বিদ্যমান --সেই কাত্যায়নী দেবীকে ধ্যান করি |
প্রণামমন্ত্র :----
_________
 "কাত্যায়নীং দশভুজাং মহিষাসুরমর্দিনীং | প্রসন্নবদনাং দেবীং বরদাং তাং নমাম্যহম || যঙ যঙ পশ্যাম্যহং দেবী স্থাবরজংমেসু চ | তং তং ব্যাপ্তং ত্বয়া সর্বং কাত্যায়নী নমহস্তুতে ||"
কাশীর নবদুর্গা - দেবী কাত্যায়নী
বীরেশ্বর মন্দিরের গর্ভগৃহে লিঙ্গের উত্তর-পূর্বকোণে দেওয়ালের নিচে দেড় হাত একটি কুলুঙ্গিতেই অধিষ্ঠান শরৎ ও বসন্তকালের শুক্লা ষষ্ঠীতে দর্শনীয়া দেবী কাত্যায়নীর। বীরেশ্বর লিঙ্গরূপায় নরমুণ্ডমাল্যশোভিত গৌরিপট্ট-ঘেরা কুণ্ডের মধ্যে বিরাজিত। তাঁর উত্তর-পূর্ব কোণে দেবী বিরাজিতা। হাত খানেক উঁচু দেবী সিংহের পিঠে দক্ষিণ চরণ ও মহিষাসুরের কাঁধে বাম চরণ স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে আছেন। অষ্টভুজা কালো পাথরের বিগ্রহ। ডান হাতের ত্রিশূল অসুরের বুকে গেঁথে আছে, অন্য হাতের কোন অস্ত্রাদিই বোঝা যায় না। সব ক্ষয়ে গিয়েছে। সবসময় যাত্রীভক্তরা জল দেওয়ায় দেবীর শরীর সব সময়ই পেছল হয়ে থাকে। শিবশক্তির একত্র সমাবেশ।
এইসব ছোট ছোট মন্দিরে দেবীদের অবস্থান দেখে মনে হয়ে কোন সময় অত্যাচারীদের হাত থেকে বিগ্রহদের রক্ষা করবার জন্য পূজারীরা তাঁদের নিজেদের বাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। মন্দিরগুলি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরে সেই সব দেবী বা দেবতাদের বিগ্রহগুলি আর স্ব-মন্দিরে ফিরে যেতে পারেননি। ঐ গৃহস্থ পূজারীর বাড়িরই কোনো অংশে বা কোনো মন্দিরের একপাশে তাঁদের ঠাঁই হয়েছিল। এই বীরেশ্বর ও কাত্যায়নী মন্দিরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে চত্বরের পাশে মঙ্গলেশ্বর ও বুধেশ্বর শিবলিঙ্গ আছেন ছোট ছোট কুণ্ডের মধ্যে। মন্দিরের দক্ষিণ দেওয়ালে তিনমুখ দত্তাত্রেয় আছেন,গণেশ আছেন,আর একেবারে প্রবেশপথের বাঁ দিকে ছোট ঘরে আধুনিক দেবতা সন্তোষী মা আছেন।
‘কাত্যায়নীং দশভুজাং মহিষাসুরঘাতিনীং নমামি বরদাং দেবীং সর্বদেবনমস্কৃতাম্।’ এই দেবী কাত্যায়নীর উদ্ভব হিমালয়ে কাত্যায়ন ঋষির আশ্রমে। ঋষি কাত্যায়ন কাত্য গোত্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি কঠোর তপস্যা করেছিলেন দেবী অম্বিকাকে তাঁর কন্যা হিসাবে পাওয়ার জন্য। দেবী তাঁর তপস্যায় প্রসন্না হয়ে সেই প্রার্থনা স্বীকার করে বলেছিলেন, দেবতাদের প্রয়োজনে আমি তোমার তপোবনে আবির্ভূত হয়ে তোমার সেবা গ্রহণ করব।
এরপরে দৈত্যরাজ মহিষাসুরের অত্যাচারে দেবতারা কাতর হয়ে একত্রে মহাশক্তির আরাধনা করবার সময় তাঁদের ক্রোধসঞ্জাত তাপ ও তেজ একত্রিত হয়ে এক অপরূপা দেবীমূর্তির সৃষ্টি হয়েছিল। দেবীকে দেবতারা নিজেদের অস্ত্র থেকে অস্ত্রাদি দিয়ে ও নানা বসনভূষণে সাজিয়ে দিয়ে তাঁর কাছে মহিষাসুর বধের জন্য প্রার্থনা জানান। সেই দেবীর সৃষ্টি হয়েছিল হিমালয়ের কাত্যায়ন ঋষির আশ্রমে দেবী কাত্যায়নকে দেওয়া তাঁর কথা রাখলেন ভাদ্র কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর দিন কাত্যায়নাশ্রমে এই দেবী প্রকট হন। তারপর সপ্তমী,অষ্টমী ও নবমীর তিনদিন এই আশ্রমে থেকে কাত্যায়নের পূজা গ্রহণ করেন। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিতে তিনি চণ্ডমুণ্ডকে চামুণ্ডামূর্তিতে বধ করেন। আর দশমীর দিন তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে মহিষাসুরকে বধ করেন। এই কারণেই দেবীর একটি নাম হয় কাত্যায়নী। কাত্যায়নপূজিতা দেবী এই নামে তিনি খ্যাত হন।
কাত্যায়নী দেবীর মাহাত্ম্য দ্বাপরের কিছু ঘটনাতেও জানা যায়। দক্ষযজ্ঞে সতীর দেহত্যাগের পর তাঁর দেহ শিবের কাঁধ থেকে বিষ্ণুচক্রে খণ্ডিত হয়ে যখন ভারতের একান্নটি স্থানে পড়ে একান্নপীঠ হলো-তখন সেই পীঠগুলিও বিভিন্ন নামে দেবী ভগবতীর মূর্তি জ্ঞানে মর্তের ভক্তদের উপাসনাস্থল হিসাবে পূজিত হতে লাগল। এই রকম একটি পীঠ হলো ব্রজধামে বৃন্দাবনে,যেখানে দেবীর কেশগুচ্ছ পড়েছিল। তাঁর সেই কুঞ্চিত দিব্য কেশপাশ প্রস্তরীভূত হয়ে আজও বিরাজিত। সেখানে তাঁর নাম কাত্যায়নী।‘ব্রজে কাত্যায়নী পরা।’ বৃন্দাবনের গোপী-গোপেরা ছিলেন শাক্ত। তাঁদের আরাধ্য দেবী ছিলেন এই কাত্যায়নী। প্রতিটি উত্সবপর্ব ঘিরে ছিল এই কাত্যায়নী দেবীকে নিয়ে। ব্রজের কুমারী গোপিনীরা এই কাত্যায়নী দেবীর কাছেই তাঁদের প্রাণধন নন্দ নন্দনকে পতি হিসাবে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল প্রার্থনা জানিয়ে ব্রত উপবাস পূজা করতেন। তাঁদের পূজার মন্ত্র ছিল,“কাত্যায়নী মহামায়ে মহাযোগিন্যধীশ্বরী/নন্দগোপসুতং দেবি পতিং মে কুরুতে নমঃ।” এই মন্ত্র ও কাহিনী শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্দে আছে। এই সিদ্ধমন্ত্র দেবী কাত্যায়নীর পূজায় উচ্চারিত হওয়ার ফলও ব্রজবিলাসিনীরা পেয়েছিলেন। দেবীর কৃপায় তাঁদের কৃষ্ণপ্রাপ্তি পরাভক্তি লাভ হয়েছিল। দেবী কাত্যায়নী সুখদা-মোক্ষদা। কৃষ্ণপ্রাপ্তিরূপ পরমানন্দ, মোক্ষ তাঁদের লাভ হয়েছিল। সত্যযুগে দেবতাদের অসুরদের হাত থেকে রক্ষা করে তাঁদের ভোগ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আর দ্বাপরে ঐকান্তিক ভক্তদের পূজায় প্রসন্না হয়ে তাঁদের নিঃশ্রেয়স্ বা পরমপ্রেমের আস্বাদন করিয়ে কৃতার্থ করেছিলেন।
বৃন্দাবনে রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম ছাড়িয়ে গোবিন্দজীর মন্দির যাওয়ার পথে ডান দিকে একটু ভেতর দিকে দেবী কাত্যায়নীর সুন্দর মন্দির। আর সেই মন্দিরে দেবী দশভুজার অষ্টধাতুর কাত্যায়নী মূর্তির কাচের আবরণে ঢাকা প্রস্তরীভূত দেবীর সেই কেশকলাপ কাত্যায়নীপীঠ নামে আজও নিত্য পূজিত। এছাড়াও বৃন্দাবনে কাত্যায়নীপীঠ বলে আরও একটি স্থান কেউ কেউ নির্দেশ করেন। এটি বৃন্দাবন পরিক্রমার পথে যমুনার ধারে মথুরার দিকে যেতে একটু জঙ্গলের মধ্যে। এখানেও একটি ছোট মন্দিরে ত্রিভুজাকার সিন্দুরলিপ্ত একটি কালো পাথরের চূড়াকে দেবী কাত্যায়নী বলে পূজা করা হয়।যাই হোক বৃন্দাবন দেবী কাত্যায়নীর বিহার ক্ষেত্র। ভক্তেরা আন্তরিক হয়ে তাঁর কাছে প্রার্থনা করলে তিনি মনস্কামনা পূর্ণ করেন-ভক্তজনের এই বিশ্বাস।

No comments:

Post a Comment