শ্রী চণ্ডী মাহাত্য
।। শ্রীদুর্গাকে প্রণাম ।।
শ্রীশ্রীদুর্গাসপ্তশতী
দ্বিতীয় অধ্যায়
দেবতাদের পুঞ্জীভূত তেজে দেবীর আবির্ভাব এবং মহিষাসুরের সৈন্য বধ
বিনিয়োগ :-
ওঁ মধ্যম চরিত্রের ঋষি বিষ্ণু, দেবতা মহালক্ষ্মী, উষ্ণিক্ ছন্দ, শাকম্ভরী শক্তি, দুর্গা বীজ, বায়ু তত্ত্ব এবং যজুর্বেদ স্বরূপ। শ্রীমহালক্ষ্মীর প্রসন্নতালাভের উদ্দেশ্যে মধ্যম চরিত্রের পাঠের বিনিয়োগ করা হয়।
ধ্যান :-
কমলাসনে অধিষ্ঠিতা, প্রসন্নাননা যিনি, যার হাতে রুদ্রাক্ষের জপমালা, কুঠার, গদা, বাণ, বজ্র, পদ্ম, ধনু, কমণ্ডলু, দণ্ড, শক্তি, খড়্গ, ঢাল, শঙ্খ, ঘন্টা, সুরাপাত্র, শূল, পাশ এবং সুদর্শনচক্র ধারণ করা আছে, সেই মহিষাসুরমর্দিনী ভগবতী মহালক্ষ্মীর ধ্যান করি।
মেধা ঋষি বললেন - ।।১।।
পূর্বকালে পূর্ণ একশ বছর ধরে দেবতা ও অসুরদের ঘোর যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে অসুরদের রাজা মহিষাসুর আর দেবতাদের অধীশ্বর ছিলেন ইন্দ্র। ওই যুদ্ধে মহাবীর অসুরদের হাতে দেবতারা পরাজিত হন। দেবতাদের পরাভূত করে মহিষাসুর স্বর্গের অধিপতি হয়ে বসলেন ।।২-৩।।
পরাজিত দেবতারা তখন প্রজাপতি ব্রহ্মাকে অগ্রবর্তী করে ভগবান শিব ও বিষ্ণুর সমীপে গমন করলেন ।।৪।।
মহিষাসুরের পরাক্রম এবং নিজেদের পরাজয়ের কাহিনী সবিস্তারে তাঁরা বিষ্ণু ও শিবের কাছে বর্ণনা করলেন ।।৫।।
তাঁরা বললেন - "হে ভগবন্! সূর্য, ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু, চন্দ্র, যম, বরুণ ও অন্যান্য দেবতাদের অধিকার হরণ করে মহিষাসুর নিজেই সব অধিকার করে বসেছে ।।৬।।
সেই দুরাত্মা মহিষাসুর সব দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে দিয়েছে। সেই সব দেবতারা এখন মানুষদের মত পৃথিবীতে বিচরণ করছেন ।।৭।।
অসুরদের দৌরাত্ম্যের সব কথাই আমরা আপানাদের জানালাম। আমরা এখন আপনাদের শরণাপন্ন হলাম। আপনারা এই মহিষাসুরের বধের কোনও ব্যবস্থা করুন ।।৮।।
দেবতাদের কাছে এই সব শুনে মধুসূদন ও মহাদেব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তাঁদের ভ্রুকুটি ভঙ্গে তাঁদের মুখ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করল ।।৯।।
তখন অত্যন্ত ক্রোধান্বিত চক্রপাণি শ্রীবিষ্ণুর বদন থেকে এক মহাতেজ নির্গত হল। সাথে সাথে ব্রহ্মা, শিব, তথা ইন্দ্রাদি অন্যান্য দেবতাদের শরীর থেকেও সুবিপুল তেজ নির্গত হল। এই সমস্ত মিলে একত্র হয়ে গেল ।।১০-১১।।
মহা মহা তেজের সেই পুজ্ঞীভূত রাশি এক জ্বলন্ত পর্বতের মত দেখা যেতে লাগল। দেবতারা দেখলেন সেই সুদীপ্ত তেজঃপুঞ্জ দশদিক ব্যাপ্ত করে রয়েছে ।।১২।।
সকল দেবতাদের শরীর থেকে নিঃসৃত সেই তেজের কোন তুলনাই হয় না। একত্র হয়ে সেই তেজ একটি নারী মূর্তি ধারণ করল এবং আপন তেজে ত্রিলোক ব্যাপ্ত করে রাখল ।।১৩।।
শম্ভুর তেজে সেই নারীমূর্তির মুখ তৈরী হল, যমের তেজে তৈরি হল মাথার চুল। বিষ্ণুর তেজে তৈরি হল তাঁর বাহুসকল ।।১৪।।
চন্দ্রতেজে তাঁর স্তনযুগল আর ইন্দ্রের তেজে শরীরের মধ্যভাগ, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও ঊরুদ্বয় এবং পৃথিবীর তেজে তাঁর নিতম্ব উদ্ভূত হল ।।১৫।।
ব্রহ্মার তেজে পদযুগল, সূর্যের তেজে পদযুগলের অঙ্গুলিসকল,অষ্টবসুর তেজে হাতের সকল আঙ্গুল এবং কুবেরের তেজে তাঁর নাসিকা উৎপন্ন হল ।।১৬।।
প্রজাপতিগণের তেজে দন্তপাটি এবং অগ্নির তেজে তিনটী চক্ষু উৎপন্ন হল ।।১৭।।
সন্ধ্যাদেবীর তেজে তাঁর ভ্রুযুগল এবং বায়ুর তেজে কান দুটী এবং এইরকম অন্যান্য দেবতাগণের তেজঃপুঞ্জ থেকেও সেই মঙ্গলময়ী দেবীর আবির্ভাব হল ।।১৮।।
তারপর সমস্ত দেবতাদের তেজরাশিসম্ভূতা দেবীকে দেখে মহিষাসুরপীড়িত দেবতারা আনন্দিত হলেন ।।১৯।।
ত্রিশূলধারী ভগবান শঙ্কর তাঁর শূল থেকে শূলান্তর এবং ভগবান বিষ্ণু চক্র থেকে চক্রান্তর উৎপাদন করে ভগবতীকে দিলেন ।।২০।।
ররুণদেব দিলেন শঙ্খ, অগ্নি দিলেন শক্তি, পবনদেব একটী ধনু ও বাণদ্বারা পূর্ণ দুটী তূণ দিলেন ।।২১।।
সহস্ত্রনয়ন দেবরাজ ইন্দ্র নিজের বজ্র থেকে বজ্রান্তর এবং ঐরাবত হাতীর গলার থেকে একটী ঘন্টাও দিলেন ।।২২।।
যমরাজ কালদণ্ড থেকে দণ্ডান্তর, জলদেবতা বরুণ নিজের পাশ থেকে একটি পাশ, প্রজাপতি রুদ্রাক্ষের মালা এবং ব্রহ্মা কমণ্ডলু দেবীকে দিলেন ।।২৩।।
সূর্যদেব দেবীর সমস্ত রোমকূপে নিজের রশ্মিজাল ভরে দিলেন। কাল অর্থাৎ মৃত্যুদেবতা একটী প্রদীপ্ত ঢাল এবং উজ্জ্বল তরোয়াল দিলেন ।।২৪।।
হ্মীরসমুদ্র দিলেন উজ্জ্বল হার ও চিরনূতন দিব্য বস্ত্রের সঙ্গে দিব্য চূড়ামণি, দুটী কুন্তল, হাতের বালা, ললাটভূষণ উজ্জ্বল অর্দ্ধচন্দ্র, সকল বাহুর জন্য কেয়ূর, দুই চরণের জন্য নির্মল নূপুর, অতি উত্তম কণ্ঠাভরণ, এবং সব আঙ্গুলের জন্য রত্নাঙ্গুরী। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা দিলেন অতি নির্মল ধারাল কুঠার ।।২৫-২৭।।
এর সাথে নানাপ্রকার অস্ত্রশস্ত্র এবং অভেদ্য কবচও দিলেন। এছাড়া মস্তক এবং বহ্মঃস্থলে ধারণ করার জন্য অম্লান পদ্মের মালা দিলেন ।।২৮।।
সমুদ্র তাঁর হাতে একটী অতি সুন্দর পদ্মফুল দিলেন। বাহনস্বরূপ সিংহ ও বিবিধ রত্ন দিলেন পর্বতাধিপতি হিমালয় ।।২৯।।
ধনাধ্যক্ষ কুবের সদাই সুরাপূর্ণ একটী পানপাত্র এবং নাগাধিপতি বাসুকি যিনি এই পৃথিবীকে ধারণ করে আছেন দেবীকে বহুমূল্য রত্নে বিভূষিত নাগহার দিলেন। এইভাবে অন্যান্য দেবগণও অলঙ্কার ও অস্ত্রশস্ত্রাদি দিয়ে দেবীকে সম্মানিত করলেন। এই সমস্ত জিনিষে সজ্জিতা হয়ে দেবী বারংবার অট্টহাস্যে হুঙ্কার করতে লাগলেন। সেই মহান ঘোর গর্জনে সমগ্র আকাশ গুজ্ঞিত হল ।।৩০-৩২।।
দেবীর সেই সিংহনাদের ভয়ানক প্রতিধ্বনি উঠল, চতুর্দশ ভুবন সংহ্মুদ্ধ, সপ্ত সমুদ্র প্রকম্পিত হতে থাকল ।।৩৩।।
পৃথিবী বিচলিত হল আর পর্বতসমূহ দুলতে লাগল। তখন দেবতারা অসীম আনন্দে সিংহবাহিনী ভবানীর জয়ধ্বনি দিয়ে বললেন - দেবি! তোমার জয় হোক ।।৩৪।।
মুনিগণ ভক্তিভরে বিনম্রভাবে দেবীকে স্তব করতে লাগলেন। সমস্ত ত্রিলোকবাসীকে সন্ত্রস্ত দেখে অসুররা নিজেদের সমস্ত সৈন্যদের সুসজ্জিত করে অস্ত্র-শস্ত্রাদ
ি উদ্যত করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল। মহিষাসুর তখন ক্রোধে সেখানে এসে বলল ---'আঃ! এ সব কি!' এই কথা বলে সব অসুরদের নিয়ে সে সেই সিংহনাদের দিকে ধাবিত হল এবং সেখানে গিয়ে যিনি নিজ অঙ্গজ্যোতিতে ত্রিভুবন আলোকিত করে রয়েছেন সেই দেবীকে দেখতে পেল ।।৩৫-৩৭।।
তাঁর পদভারে পৃথিবী নত হয়ে পড়েছে। তাঁর মাথার মুকুট আকাশে রেখা টানার ন্যায় স্পর্শ করেছে এবং তার ধনুকের টঙ্কার পাতাল পর্যন্ত সাত নিম্নলোক আকুলিত করছে ।।৩৮।।
তাঁর সহস্র বাহুতে দশদিক আচ্ছাদিত করে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। তখন অসুরদের সাথে দেবীর যুদ্ধ আরাম্ভ হল ।।৩৯।।
নানারকম নিক্ষিপ্ত অস্ত্রশস্ত্রের দীপ্তিতে দশদিক উদ্ভাষিত হতে লাগল। মহিষাসুরের সেনাপতির নাম মহাসুর চিক্ষুর ।।৪০।।
সে দেবীর সাথে যুদ্ধ করতে লাগল। চতুরঙ্গিণী বাহিনী পরিবেষ্টিত চামর অন্য অসুরগণকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধ আরম্ভ করল। ষাট হাজার রথীদের সঙ্গে নিয়ে উদগ্র নামে মহাসুর যুদ্ধ আরম্ভ করল ।।৪১।।
এক কোটি রথী নিয়ে মহাহনু অসুর যুদ্ধ করতে এল। অসিলোমা নামে মহাসুর, যার গায়ের রোমসমূহ অসির মত তীক্ষ্ন ছিল, পাঁচ কোটি রথী নিয়ে যুদ্ধ আরম্ভ করল ।।৪২।।
ষাট লাখ রথী নিয়ে বাস্কলাসুর রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে লাগল। পরিবারিত নামে এক মহাসুর বহু সহস্র হাতী ও অশ্বারোহীর সঙ্গে এক কোটি রথীকে নিয়ে যুদ্ধ করতে লাগল। বিড়াল নামের মহাসুর পাঁচ অর্বুদ রথীদের নিয়ে যুদ্ধ আরম্ভ করল। এরা ছাড়াও অন্যান্য বহুসংখ্যক মহাসুরগণ রথ, হাতী, ঘোড়া, সৈন্যসামন্ত নিয়ে দেবীর সাথে যুদ্ধ করতে লাগল। স্বয়ং মহিষাসুর সেই যুদ্ধে কোটি কোটি সহস্র রথ, হাতী ও অশ্বারোহী সেনাদের নিয়ে যুদ্ধ আরম্ভ করল। সেই সব মহাসুরেরা তোমর(শাবল), ভিন্দিপাল, শক্তি, মুষল, খড়্গ, পরশু(কুঠার) এবং পট্টিশ প্রভৃতি অস্ত্রসমূহ দ্বারা দেবীর সাথে যুদ্ধ করতে লাগল। কিছু সংখ্যক অসুর আবার শক্তি, কেউ কেউ পাশ দেবীর ওপর নিক্ষেপ করল ।।৪৩-৪৮।।
কেউ কেউ বা খড়্গের আঘাতে দেবীকে বধ করবার চেষ্টা করল। দেবীও অনায়াসেই নিজের অস্ত্র-শস্ত্র বর্ষণ করে অসুরদের সেই সব অস্ত্র-শস্ত্রকে ছেদন করলেন। তাঁর মুখের ওপর পরিশ্রম বা ক্লান্তির কোনও চিহ্নমাত্রও দেখা গেল না, দেবতা ও ঋষিগণ তাঁকে স্তুতি করতে থাকলে ভগবতী পরমেশ্বরী অসুরদের শরীরে অস্ত্রশস্ত্রাদি নিক্ষেপ করতে লাগলেন। দেবীর বাহন সিংহও ক্রোধে কেশর ফুলিয়ে অসুরসৈন্যের মধ্যে দাবানলের মত বিচরণ করতে লাগলেন। রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে করতে অম্বিকাদেবী যত নিঃশ্বাস ফেললেন, সেই সব নিঃশ্বাস হতে তৎক্ষনাৎ শত শত সহস্র সহস্র দেবীর গণ অর্থাৎ দেবীর সৈন্যরূপে উৎপন্ন হলেন এবং পরশু, ভিন্দিপাল, খড়্গ তথা পট্টিশাদি অস্ত্রদ্বারা অসুরদের বধ করতে লাগলেন ।।৪৯-৫৩।।
দেবীর শক্তিতে শক্তিমান হয়ে সেই দেবীসৈন্যেরা নাগাড়া ও শঙখ ইত্যাদি বাজাতে বাজাতে অসুরসেনা ধ্বংস করতে লাগলেন ।।৫৪।।
সেই যুদ্ধমহোৎসবে দেবীসৈন্যরা মৃদঙ্গ বাজাচ্ছিলেন। অতঃপর দেবী নিজে ত্রিশূল, গদা, শক্তি অস্ত্র বর্ষণ করে এবং খড়্গ ইত্যাদি দ্বারা শত শত মহাসুর বিনাশ করলেন। অপর কতকগুলি অসুরকে ঘন্টার ভয়ঙ্কর ধ্বনি দিয়ে বিমোহিত করে বধ করলেন ।।৫৫-৫৬।।
আবার কতকগুলিকে পাশবদ্ধ করে ভূমিতে পাতিত করলেন। কত না অসুর তাঁর তীক্ষ্ন তরোয়ালের আঘাতে দু টুকরো হয়ে প্রাণত্যাগ করল ।।৫৭।।
কতকগুলি গদাঘাতে চূর্ণ হয়ে ভূতলে নিপাতিত হল। অনেকগুলো আবার মুষলাঘাতে আহত হয়ে রক্ত বমন শুরু করল। সেই যুদ্ধক্ষেত্রে কোনও কোনও অসুর সর্বাঙ্গে বাণবিদ্ধ হয়ে প্রাণত্যাগ করল ।।৫৮-৫৯।।
বাজপাখীর মত ঝাপটাদেওয়া দেবশত্রু অসুরগণ নিজেদের প্রাণ দিয়ে নিজেদের ক্ষয় করতে লাগল। কারও কারও বাহুসকল ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। কারোর ঘাড় ভেঙ্গে গেল। কারো কারো মস্তক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে লাগল। কারোর দেহের মধ্যভাগ বিদীর্ণ হয়ে গেল। কতকগুলোর জঙ্ঘা ছিন্ন হয়ে মাটীতে লুটাতে লাগল। অনেককে দেবী এক বাহু, এক পা, আবার এক চক্ষু করে দ্বিখণ্ডিত করে মাটীতে লুটিয়ে দিলেন। কতকগুলি অসুরের মস্তক ছিন্ন হওয়া সত্তেও মাটিতে পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়াল এবং মস্তকহীন শরীরে ভাল ভাল অস্ত্র নিয়ে দেবীর সাথে যুদ্ধ করতে লাগল। অনেকগুলো কবন্ধ আবার যুদ্ধের বাজনার তালে তালে নৃত্য করতে লাগল ।।৬০-৬৩।।
কিছু কিছু কবন্ধ খড়্গ, শক্তি ও খষ্টি হাতে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল এবং অন্যান্য মহাসুরেরা 'দাঁড়াও দাঁড়াও' বলে দেবীকে যুদ্ধে আহ্বান করতে লাগল। যেখানে ওই বিশাল মহাযুদ্ধ হয়েছিল, সেখানকার পৃথিবীর জায়গাগুলি দেবীর দ্বারা পাতিত রথ, হাতী, ঘোড়া এবং অসুরদের মৃতদেহে এমন স্তূপীকৃত হয়েছিল যে, সে সব জায়গায় চলাফেরাও করা যাচ্ছিল না ।।৬৪-৬৫।।
অসুর সৈন্যদের হাতী, ঘোড়া এবং মৃতদেহের থেকে এতই রক্তপাত হয়েছিল যে অল্পক্ষণের মধ্যেই সেখানে বড় বড় রক্তনদী বইতে লাগল ।।৬৬।।
আগুন যেমন তৃণ ও কাঠের বিশাল বিশাল স্তূপকে মুহূর্তের মধ্যেই ভস্মসাৎ করে দেয়, জগদম্বাও তেমনই ক্ষণকাল মধ্যে অসুরদের বিশাল সেনাকে বিনাশ করলেন ।।৬৭।।
আর সেই সিংহও কেশর ফুলিয়ে ফুলিয়ে ভীষণ গর্জন করতে করতে অসুরদের দেহ থেকে প্রাণ বের করে নিচ্ছিলেন ।।৬৮।।
যুদ্ধক্ষেত্রে দেবীর সৈন্যগণও সেই অসুরদের সাথে এমন ভীষন যুদ্ধ করলেন যে আকাশ থেকে দেবতাগণ তাঁদের ওপর পুষ্পবৃষ্টি করে আনন্দ প্রকাশ করলেন ।।৬৯।।
শ্রীমার্কন্ডেয়পুরাণে সাবর্ণিকমন্বন্তরে দেবীমাহাত্ম্য প্রসঙ্গে মহিষাসুরসৈন্যবধ
নামক দ্বিতীয় অধ্যায় সম্পূর্ণ হল ।।২।।
Wednesday, 27 December 2017
Chanti Path Chapter 2 শ্রীশ্রীদুর্গাসপ্তশতী দ্বিতীয় অধ্যায়
Monday, 25 December 2017
Lakshmi Astottarasatanaam (108 names of Lakshmi in Bengali)
শ্রীশ্রী লক্ষ্মীর অষ্টোত্তর শতনাম
পন্ডিত কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন সম্পাদিত
শতনাম স্তোত্র
পদ্মপলাশাক্ষি নামে গাও জয় জয় | ১
মহালক্ষ্মী নামে হয় সর্ব্বরোগ ক্ষয় || ২
সুরেশ্বরী নামে নতি করি ভক্তিভরে | ৩
হরিপ্রিয়া নাম স্মরি অন্তর-মাঝারে || ৪
পদ্মালয়া নামে লক্ষ্মী-পদে নমস্কার | ৫
সর্ব্বদাত্রী নামে হয় বিভব-সঞ্চার || ৬
বিশ্বেশ্বরী নামে ডাকি কমলা দেবীরে | ৭
ক্ষীরোদধিসুতা নাম স্মরি ভক্তিভরে || ৮
জগন্মাতা নামে নতি পদ্মযুগে করি | ৯
হৃদিমাঝে দয়াবতী নাম সদা স্মরি || ১০
ত্রৈলোক্যতারিণী নাম করি গো স্মরণ | ১১
বসুবৃষ্টিকরী নাম জগত-পাবন || ১২
সর্ব্বভূতহিতৈষিণী নামে নমস্কার | ১৩
দেবদেবেশ্বরী নাম সার হৈতে সার || ১৪
ভুবনপাবনী নাম স্মরি গো অন্তরে | ১৫
চপলা নামেতে নতি করি ভক্তিভরে || ১৬
ভুবন জননী নাম স্মরি বার বার | ১৭
আর্ত্তিহন্ত্রী নাম স্মরি অন্তর মাঝার || ১৮
ওগো দেবী তব নাম দারিদ্র-হরণী | ১৯
স্মরিলে দুঃখের নাম কমলবাসিনী || ২০
ললিতা নামেতে নতি তোমার চরণে | ২১
প্রদ্যুম্ন জননী নাম স্মরি হৃষ্টমনে || ২২
শরণ্যা নামেতে হয় দুঃখ বিনাশন | ২৩
শীলাবতী নামে স্মরে যত ভক্তগণ || ২৪
পিতৃ-মাতৃরূপা নাম স্মরি হৃদিমাঝে | ২৫
সম্পত্তিদায়িনী নামে সবে সুখে মজে || ২৬
বিদ্যাদাত্রী নাম তব জগতে প্রচার | ২৭
কল্যাণী নামেতে তোমা করি নমস্কার || ২৮
সাগর-নন্দিনী নাম সাগর-ভবনে | ২৯
গুণরাশি-প্রসবিনী তোমা সবে ভণে || ৩০
ক্ষমাশীলা নাম তব বিদিত ভুবন | ৩১
ভগবতী নামে তোমা ডাকে সর্ব্বজন || ৩২
শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপিণী তোমারই নাম | ৩৩
সম্পত্তি-রূপিণী হয় তোমার আখ্যান ||৩৪
পার্ব্বতী নামেতে তুমি বিরাজ কৈলাসে | ৩৫
স্বর্গলক্ষ্মী নাম তব অমর নিবাসে || ৩৬
মর্ত্ত্যলক্ষ্মী নাম তব ভূতলে প্রচার | ৩৭
গৃহলক্ষ্মী নাম খ্যাত গৃহীর আগার || ৩৮
বৈকুন্ঠে বৈকুন্ঠপ্রিয়া তব এক নাম | ৩৯
গৃহে গৃহে ঘোষে তব তুলসী আখ্যান || ৪০
ব্রহ্মলোকে তব নাম সাবিত্রী সুন্দরী | ৪১
বৃন্দাবন-বনে নাম ধর রাসেশ্বরী || ৪২
গোলকে তোমার নাম কৃষ্ণপ্রাণাধিকা | ৪৩
ভক্ত-হৃদে তব নাম সর্ব্বার্থ-সাধিকা || ৪৪
মালতী নামেতে থাক মালতী-কাননে | ৪৫
চন্দ্রা নামে শোভা পাও চন্দনের বনে || ৪৬
সুন্দরী তোমার নাম শতশৃঙ্গে জানি | ৪৭
কুন্দবনে কুন্ডদন্তী নামে খ্যাত তুমি || ৪৮
পদ্মাবতী নাম তব হয়. পদ্মবনে | ৪৯
কৃষ্ণপ্রিয়া তব নাম ভান্ডীর-কাননে || ৫০
কেতকী-কাননে তব সুশীলা আখ্যান | ৫১
রাজগৃহে রাজলক্ষ্মী তব এক নাম || ৫২
আত্মবিদ্যা নামে তুমি খ্যাত সর্ব্বস্থানে | ৫৩
সিদ্ধগণ ডাকে তোমা সিদ্ধিদাত্রী নামে || ৫৪
এক নাম ধর তুমি শ্রীকদম্বমালা | ৫৫
কোচবধূপুরে তুমি কোচরাজবালা || ৫৬
সুমতি নামেতে তুমি খ্যাত সর্ব্বস্থান | ৫৭
কুমতি নাশিনী হয় তব এক নাম || ৫৮
এক নাম ধর তুমি সুপ্রিয়বাদিনী | ৫৯
কুলিনা তোমার নাম ওগো সুভাষিণী || ৬০
স্বাহা নামে শোভা পাও অগ্নির গোচরে | ৬১
স্বধা নাম ধর সদা পিতৃলোকপুরে || ৬২
যজ্ঞবিদ্যা তব নাম জগতে প্রচার | ৬৩
গুহ্যবিদ্যা নামে তোমা করি নমস্কার || ৬৪
আন্বীক্ষিকী তব নাম বিদিত ভুবন | ৬৫
দন্ডনীতি বলি নাম করহ ধারণ || ৬৬
জগদ্রূপা নামে তুমি বিদিত জগতে | ৬৭
সুধা নামে খ্যাত তুমি শশাঙ্কপুরেতে || ৬৮
এক নাম মেধা তুমি করিছ ধারণ | ৬৯
শ্রদ্ধা নামে ডাকে তোমা শ্রদ্ধাশীল জন || ৭০
সর্ব্বত্র বিদিত তুমি মহাবিদ্যা নামে | ৭১
মৃতসঞ্জীবনী নাম শমন-ভবনে || ৭২
মহাভাগা এক নাম জানি গো তোমার | ৭৩
সর্ব্বযজ্ঞময়ী নাম সর্ব্বত্র প্রচার || ৭৪
মোক্ষদা নামেতে কর মোক্ষ বিতরণ | ৭৫
সুরভি নামেতে কর গো-ধন রক্ষণ || ৭৬
সুখদা নামেতে সুখ দেও সবাকারে | ৭৭
হর্ষদা নামেতে তোমা স্মরি বারে বারে || ৭৮
শ্রীদাত্রী তোমার নাম করি গো স্মরণ | ৭৯
শস্যা নামে কর তুমি শস্য বিতরণ || ৮০
মহাদেবী তব নাম হিমালয়-ঘরে | ৮১
সুমেরুবাসিনী নাম সুমেরু-শিখরে || ৮২
ধর্ম্মদাত্রী তব নাম ধর্ম্মের গোচর | ৮৩
প্রভাবতী নামে ডাকে সতত ভাস্কর || ৮৪
পরমার্থদাত্রী নাম করহ ধারণ | ৮৫
ক্রোধহীনা তব নাম বিদিত ভুবন || ৮৬
হরিদাস্যপ্রদায়িনী আখ্যান তোমার | ৮৭
কারণরূপিণী নাম জগতে প্রচার || ৮৮
অসারহারিণী নাম খ্যাত সর্ব্বস্থানে | ৮৯
নারায়ণ পরায়ণা নামে তোমা ভণে || ৯০
এক নাম ধর তুমি মহাপুণ্যবতী | ৯১
নন্দিকেশী নাম তব খ্যাত বসুমতী || ৯২
শচী নামে শোভা পাও দেবরাজপুরে | ৯৩
ভোগবতী নামে থাক পাতাল-নগরে || ৯৪
অরিষ্টনাশিনী নাম জগতে প্রচার | ৯৫
হরিহৃদিবিলাসিনী হরির আগার || ৯৬
একবীরা নাম তুমি করহ ধারণ | ৯৭
ভ্রামরী নামেতে কর ভুবন ভ্রমণ || ৯৮
বিরোধিনী তব নাম খ্যাত ভূমন্ডলে | ৯৯
দিগ্ গজগণেরা তোমা বিধাতৃকা বলে || ১০০
শিবদূতী নাম তব জগতে প্রচার | ১০১
ষট্ রূপা তব নাম বেদের মাঝার || ১০২
হুঙ্কাররূপিণী নাম সমর-অঙ্গনে | ১০৩
জৃম্ভণী নামেতে খ্যাত যোদ্ধার সদনে || ১০৪
ভক্তাভীষ্টবিধায়িণী তব এক নাম | ১০৫
বিনোদিনী নামে তুমি খ্যাত সর্ব্বস্থান || ১০৬
মদন-দমনী নাম মদনের পুরে | ১০৭
শ্রীরতিসুন্দরী নাম রতির গোচরে || ১০৮
নামমালা ভক্তিভরে করিয়া শ্রবণ |
শ্রীলাভ করেন পুনঃ অমর-রাজন ||
ফলশ্রুতি
এই স্তব ভক্তিভরে করিলে শ্রবণ |
কিম্বা অধ্যয়ণ করে যদি কোন জন ||
পাতক তাহার দেহে কভু নাহি রয় |
পুত্রহীন জন পায় সুপুত্র নিশ্চয় ||
ভ্রষ্টরাজ্য রাজা পায় ইহার প্রসাদে |
কীর্ত্তিহীন কীর্ত্তি লভে জানিবে জগতে ||
যশোলাভ ধনলাভ ইহাতেই হয় |
কল্যাণজনক স্তোত্র শাস্ত্রে হেন কয় ||
তাই বলি ভক্তগণ একান্ত অন্তরে |
সদা শুন, সদা পড় ভক্তি সহকারে ||
কমলে কমলে বলি ডাক নিরন্তর |
ডঙ্কা মারি যাবে চলি অমর-নগর ||Saturday, 5 August 2017
Devi Bhagwat Puran Chapter 3, দেবী ভাগবত পুরাণ তৃতীয়োধ্যায়
দেবী ভাগবত পুরাণ
শ্রীমদ্দেবীভাগবত-মাহাত্য
তৃতীয়োধ্যায়
দেবীভাগবত মাহাত্য-প্রসঙ্গে রাজা সুদ্যুম্নের স্ত্রী হবার এবং শ্রীমদ্দেবীভাগবত-শ্রবণের ফলস্বরূপ চিরকালের জন্য পুরুষ হয়ে রাজ্যলাভ তথা পরমপদ প্রাপ্ত করিবার কথা
ঋষি সূত বললেন -
হে মুনিগণ! এবার দ্বিতীয় ইতিহাস শ্রবণ করুন, যেখানে দেবীভাগবতের মাহাত্য গান করা হয়েছে ।।১।।
একবার লোপামুদ্রাপতি মুনি কুম্ভযোনি (অগস্ত্য) কুমারের নিকট গমন করিলেন এবং তাঁর বন্দনা করে তাঁকে বিবিধ কথা জিজ্ঞাসা করিলেন ।।২।।
ভগবান স্কন্দ তাঁকে দান, তীর্থ, ব্রতের মাহাত্য সম্বন্ধে অনেক কথা শোনালেন ।।৩।।
তিনি বারাণসী, মণিকর্ণীকা, গঁঙ্গা আদি তীর্থের মাহাত্য অনেক বিস্তার করে বর্ণণা করিলেন ।।৪।।
এই সমস্ত কথা শ্রবণ করে মুনিবরের প্রীতি হল। লোকের হিতার্থে তিনি পরম তেজস্বী কুমারকে পুনঃ জিজ্ঞাসা করিলেন ।।৫।।
অগস্ত্য মুনি বললেন -
হে তারকাসুরের সংহারকারী ভগবান! হে প্রভু! এবার দেবীভাগবতের মাহাত্য এবং তাঁর শ্রবণ বিধি বলিবার কৃপা করুন ।।৬।।
যেখানে ত্রিলোকজননী শাশ্বতী দেবীর চরিত্র গায়ন করা হয়েছে। দেবীভাগবত নামক পুরাণ পরমোত্তম ।।৭।।
ভগবান স্কন্দ বললেন -
হে ব্রহ্মন্! শ্রীভাগবতের মাহাত্যকে বিস্তারে কে বলতে পারে? তবুও আমি এখন সংক্ষেপে বলছি, শ্রবণ করুন ।।৮।।
যিনি নিত্যা, সচ্চিদানন্দরূপিণী জগদম্বিকা, ভুক্তিমুক্তিপ্রদায়িনী তিনিই সেই ভাগবতে সাক্ষাত বিরাজমান ।।৯।।
অতএব মুনি! এই দেবীভাগবতকে দেবীর বাঙ্ময়ী মুর্তি বলা হয়। এর পঠন এবং শ্রবণ করিলে জগতের কিছুই দুর্লভ থাকে না ।।১০।।
শুনেছি বিবস্বানের পুত্র শ্রাদ্ধদেব ছিলেন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। বশিষ্ঠমুনির সম্মতিতে রাজা পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করিলেন ।।১১।।
মনুর দয়িতা শ্রদ্ধা হোতার নিকট প্রার্থনা করিলেন - "হে ব্রহ্মন্! আপনি যজ্ঞবিধিতে এমন কিছু উপায় করুন যাতে আমার কন্যা হয়।" ।।১২।।
তখন হোতা মনে 'কন্যা উদ্ভব হোক' এই চিন্তা করে যজ্ঞ করিলেন। এই ব্যভিচারের কারণে ইলা নামক কন্যা উৎপন্ন হল ।।১৩।।
অতএব রাজা সুতাকে দর্শন করে গুরুকে নিরাশ মনে জিজ্ঞাসা করিলেন - "হে প্রভু! আপনার সংকল্পে এমন বৈষম্য হল কেমন করে?" ।।১৪।।
এই শুনে মুনি(বশিষ্ঠ) ধ্যানস্ত হয়ে জ্ঞাত হলেন যে হোতা এই ব্যতিক্রমের কারণ। তখন ইলার জন্য পুরুষত্ব কামনা করে তিনি ঈশ্বরের শরণ গ্রহণ করিলেন ।।১৫।।
মুনির তপের প্রভাবে এবং পরেশানুগ্রহে সব লোকের মধ্যে ইলা দেখতে দেখতেই পুরুষরূপে পরিণত হল ।।১৬।।
সেই সময় গুরু সংস্কার করে তাঁর সুদ্যুম্ন নাম রাখিলেন। সেই মনুসুত এমন বিদ্যানিধি হল যেন সরিতা রূপি সাগর (অর্থাৎ তাঁর সাগরের সম বিদ্যা সরিতা রূপে প্রবাহিত হত) ।।১৭।।
কালক্রমে যখন সুদ্যুম্ন অরুণ(নবোদিত সূর্যের মত রূপ ও গুণ) হল, তখন সে মৃগার্থে (শিকার করিতে) তাঁর সৈন্ধ (অশ্বের এক প্রকার) অশ্বে আরূঢ় হয়ে বনে গমন করিলেন ।।১৮।।
সে তাঁর সাথীদের সহিত ভ্রমণ করিতে করিতে একের পর এক বহু বনে গমন করিল। দৈব ইচ্ছাতেই সেই কুমারেরা হিমাদ্রির নীচভাগে অবস্থিত এক বনে আসিল ।।১৯।।
কোন এক সময়ে এখানে ভার্যা অপর্ণা সহিত দেবাধিদেব ভগবান শঙ্কর আনন্দে রমণ করছিলেন ।।২০।।
তখন সেখানে শিবদর্শনলালসায় মুনিগণ আগমন করিলেন। তাঁদের দর্শন করে গিরিজা লজ্জিত হয়ে গেলেন ।।২১।।
গিরিশা সহিত তাঁহাকে রমন করিতে দেখে নিবৃত্ত সংশিতব্রতী মুনিগণ বৈকুণ্ঠে নিলয়ে গমন করিলেন ।।২২।।
প্রিয়ার প্রিয় মনের ইচ্ছা করে তিনি (মহাদেব) সেই অরণ্যকে অভিশাপ দিলেন - "এখন থেকে আরম্ভ করে যেই পুরুষ এখানে প্রবেশ করিবে সে স্ত্রীতে পরিণত হবে।" ।।২৩।।
তখন থেকে আরম্ভ করে সেই দেশে পুরুষেরা বর্জিত। সেখানে প্রবেশ করে সুদ্যুম্ন নারীশ্রেষ্ঠাতে পরিণত হল ।।২৪।।
তাঁর অনুগামীরা স্ত্রীতে তথা অশ্ব অশ্বীতে পরিণত হয়েছে দেখে সে (সুদ্যুম্ন) বিস্মিত হল। অতএব সেই সুন্দরী নারী বনে-বনে বিচরণ করিতে লাগিল ।।২৫।।
একবার তিনি বুধের আশ্রমের সান্নিধ্যে গমন করিলেন। ভগবান বুধ তাঁকে দর্শন করে, যিনি চারুসর্বাঙ্গী তথা যার পীনোন্নত পয়োধর, যিনি বিম্বোষ্ঠী, কুন্দদন্তী (কুন্দ পুষ্পের মত সুন্দর দাঁত), সুমুখী তথা উৎপলাক্ষী; অনঙ্গশর (কামদেবের বাণ) ভগবান বুধকে বিদ্ধাঙ্গ (মায়াশক্তির দ্বারা অঙ্গে আহত করে) করে তাঁর মনে কাম বাসনা উৎপন্ন করিল ।।২৬-২৭।।
তিনিও (ইলা) সেই সুভ্রূ কুমারকে, যিনি সোমনন্দন, কামনা করিলেন। তখন তিনি বুধের সহিত হাস্য (আনন্দ) করিয়া তাঁর আশ্রমে বাস করিতে লাগিলেন ।।২৮।।
অতএব কালক্রমে তিনি (বুধ) তাঁর থেকে, যিনি মিত্রাবরুণের কৃপায় জন্মেছিলেন (মনু পুত্রের জন্য মিত্রবরুণের যজ্ঞ করেছিল),পুরূরবা নামক এক পুত্র উৎপন্ন করিলেন ।।২৯।।
অতএব বুধাশ্রমে বহু বর্ষ ব্যতীত হয়ে গেল। কদাচিৎ তাঁর পূর্ববৃত্তান্ত মনে পরে গেল, তিনি দুঃখিত হয়ে (আশ্রম হইতে) গমন করিলেন ।।৩০।।
গুরুর আশ্রমে অতএব গমন করে তিনি বশিষ্ঠকে প্রণাম করিলেন। তাঁর বৃত্তান্ত নিবেদন করে তাঁর নিকট পুরুষত্ব প্রাপ্ত করার অভিপ্রায় প্রকট করে তাঁর শরণাপন্ন হলেন ।।৩১।।
সমস্ত বৃত্তান্ত জ্ঞাত হওয়ার পর বশিষ্ঠ পূর্বের মতন (পূর্বে যেমন ভগবান শিবের শরণাপন্ন হয়েছিলেন তেমন) কৈলাসে গমন করিলেন। (তিনি) পরম শম্ভুকে ভক্তিদ্বারা তুষ্ট করিবার জন্য পূজায় লীন হলেন ।।৩২।।
বশিষ্ঠ মুনি বললেন -
হে শিব, হে শঙ্কর, হে কপর্দিন আপনাকে প্রণাম। হে চন্দ্রমৌলী, আপনার অর্ধ অঙ্গে গিরিজা বিরাজ করে, আপনাকে প্রণাম ।।৩৩।।
হে মৃণ্ড, হে সুখদাতা, হে কৈলাসবাসী আপনাকে প্রণাম। হে নীলকণ্ঠ, আপনি ভক্তদের ভুক্তিমুক্তি প্রদান করেন, আপনাকে প্রণাম ।।৩৪।।
হে শিব, হে শিবরূপ, হে প্রপন্নভয়হারী আপনাকে প্রণাম। হে বৃষভবাহ, হে শরণ্য, হে পরাত্মা, আপনাকে প্রণাম ।।৩৫।।
আপনি সর্গ, স্থিতি ও লয়কালে ব্রহ্ম, বিষ্ণু এবং ঈশরূপ ধারণ করেন, আপনাকে প্রণাম। হে দেবাধিদেব, হে বরদ, হে পুরারি, আপনাকে প্রণাম ।।৩৬।।
হে যজ্ঞরূপ, আপনি যাচকের ফলদাতা, আপনাকে প্রণাম। হে গঙ্গাধর, সূর্য, ইন্দু তথা শিখা আপনার নেত্র, আপনাকে প্রণাম ।।৩৭।।
এই প্রকার স্তুতি করাতে জগৎপতি ভগবানের বৃষারূঢ়রূপে অম্বিকাসহ প্রাদুর্ভাব হল। তাঁর প্রভা কোটি সূর্য সম, তিনি রজতাচল সংকাশ (রজতাচল সদৃশ তাঁর স্বচ্ছ কান্তি), ত্রিলোচন, চন্দ্রশেখর। তিনি মুনিশ্রেষ্ঠর প্রণতিতে পরিতুষ্ট হয়ে বললেন ।।৩৮-৩৯।।
শ্রীভগবান বললেন -
হে বিপ্রর্ষি! আপনার মনে যা আছে সেই বর চান। ভগবানের এমন উক্তির পর বশিষ্ঠ মুনি তাঁকে প্রণাম করে অভ্যর্থনা করে ইলার পুরুষত্ব যাচনা করিলেন ।।৪০।।
অতএব ভগবান মুনিশ্রেষ্ঠকে প্রসন্ন হয়ে কহিলেন :- (ইলা) মাসে পুরুষ হবে তথা মাসে নারী হবে ।।৪১।।
এইভাবে শম্ভুর থেকে বর প্রাপ্ত করে হর্ষিত হয়ে (তিনি) বরদানোন্মুখী দেবী জগদম্বিকা মহেশ্বরীকে প্রণাম করিলেন ।।৪২।।
কোটি চন্দ্রকলা সম তাঁর কান্তি, তিনি সুস্মিতা। ইলার জন্য চিরপুরুষত্ব কামনা করে তিনি(বশিষ্ঠ) তাঁকে ভক্তিদ্বারা তুষ্ট করার জন্য পরিপূজন করিলেন ।।৪৩।।
জয় দেবী মহাদেবী ভক্তানুগ্রহকারিণি, জয় সর্বসুরারাধ্যা, জয় অনন্তগুণালয় ।।৪৪।।
নমো নমো দেবেশি, শরণাগতবৎসলা। জয় দুর্গে, দুঃখহন্ত্রি, দুষ্টদৈত্যসংহারিণী ।।৪৫।।
নমো ভক্তিগম্যে (যার নিকট ভক্তি দ্বারা গমন করা যায়), মহামায়ে, জগদম্বিকে। আপনার পদঅম্বুজ সংসার সাগর পার করার তরী ।।৪৬।।
ব্রহ্মা আদি জ্ঞানিও (আদি জ্ঞানি দেবগণও) আপনার পদঅম্বুজের সেবার দ্বারাই বিশ্বের সর্গস্থিতিলয়ের প্রভুত্ব লাভ করেন ।।৪৭।।
হে দেবেশি! আপনি চতুর্বর্গপ্রদায়িনি, আপনি প্রসন্না হওন। হে দেবী! আপনার স্তুতি করার ক্ষমতা কার আছে? আমি কেবল প্রণাম করছি ।।৪৮।।
এই স্তুতি করাতে ভগবতী দুর্গা যিনি পরা নারায়ণী, বশিষ্ঠ মুনির ভক্তিতে তৎক্ষণাৎ প্রসন্না হলেন ।।৪৯।।
তখন মহাদেবী, যিনি ভক্তের প্রতিকূল অবস্থাকে হরণ করেন, মুনিকে কহিলেন - সুদ্যুম্নের ভবনে গমন করে ভক্তিভরে আমার অর্চনা কর ।।৫০।।
হে দ্বিজোত্তম! তুমি সুদ্যুম্নকে প্রীতিপুর্বক নয় দিনে দেবী ভাগবত নামের আমার প্রিয় পুরাণ শুনাও ।।৫১।।
তাঁহা শ্রবণ করিলেই সতত সে পুরুষ হবে। এই উক্তি করে শিবেশ্বরী অন্তর্ধ্যান হয়ে গমন করিলেন ।।৫২।।
বশিষ্ঠ সেই দিশাকে নমন করে নিজ আশ্রমে সমাগম করিলেন। সুদ্যুম্নকে ডেকে দেবীর আরাধনা করার আদেশ দিলেন ।।৫৩।।
আশ্বিনের শুক্লপক্ষে নবরাত্র বিধিতে জগদম্বিকার পূজা করে ভূপতিকে (সুদ্যুম্নকে) (দেবী ভাগবত পুরাণ) শোনানো প্রারম্ভ করিলেন ।।৫৪।।
সুদ্যুম্নও ভক্তিভরে শ্রীমদ্ভাগবতামৃত শ্রবণ করিলেন। (তারপর) গুরুকে পূজা করে তথা প্রণাম করে চিরপুরুষত্ব লাভ করিলেন ।।৫৫।।
মহর্ষি বশিষ্ঠ (সুদ্যুম্নকে) রাজ্যাসনে অভিষিক্ত করিলেন। প্রজাকে প্রসন্ন করে তিনি ভুবনে ধর্ম দ্বারা শাসন করিলেন ।।৫৬।।
তিনি বিবিধ বরদক্ষিণাসম্পূর্ণ যজ্ঞ করিলেন। তারপর পুত্রগণের উপর রাজ্যের নির্দেশনা দিয়ে তিনি দেবীর লোককে প্রাপ্ত হলেন ।।৫৭।।
বিপ্রগণ, সেই ইতিহাসের কথা শেষ হল। মনুষ্য যদি ভক্তিসহ দেবীর প্রসাদ রূপী এই পরমামৃত পঠন বা শ্রবণ করে সে ইহলোকে সকল কামনা প্রাপ্ত হয় তথা অন্তে দেবীর লোকে গমন করে ।।৫৮।।
শ্রীমদ্দেবীভাগবত-মাহাত্য
তৃতীয়োধ্যায়
দেবীভাগবত মাহাত্য-প্রসঙ্গে রাজা সুদ্যুম্নের স্ত্রী হবার এবং শ্রীমদ্দেবীভাগবত-শ্রবণের ফলস্বরূপ চিরকালের জন্য পুরুষ হয়ে রাজ্যলাভ তথা পরমপদ প্রাপ্ত করিবার কথা
ঋষি সূত বললেন -
হে মুনিগণ! এবার দ্বিতীয় ইতিহাস শ্রবণ করুন, যেখানে দেবীভাগবতের মাহাত্য গান করা হয়েছে ।।১।।
একবার লোপামুদ্রাপতি মুনি কুম্ভযোনি (অগস্ত্য) কুমারের নিকট গমন করিলেন এবং তাঁর বন্দনা করে তাঁকে বিবিধ কথা জিজ্ঞাসা করিলেন ।।২।।
ভগবান স্কন্দ তাঁকে দান, তীর্থ, ব্রতের মাহাত্য সম্বন্ধে অনেক কথা শোনালেন ।।৩।।
তিনি বারাণসী, মণিকর্ণীকা, গঁঙ্গা আদি তীর্থের মাহাত্য অনেক বিস্তার করে বর্ণণা করিলেন ।।৪।।
এই সমস্ত কথা শ্রবণ করে মুনিবরের প্রীতি হল। লোকের হিতার্থে তিনি পরম তেজস্বী কুমারকে পুনঃ জিজ্ঞাসা করিলেন ।।৫।।
অগস্ত্য মুনি বললেন -
হে তারকাসুরের সংহারকারী ভগবান! হে প্রভু! এবার দেবীভাগবতের মাহাত্য এবং তাঁর শ্রবণ বিধি বলিবার কৃপা করুন ।।৬।।
যেখানে ত্রিলোকজননী শাশ্বতী দেবীর চরিত্র গায়ন করা হয়েছে। দেবীভাগবত নামক পুরাণ পরমোত্তম ।।৭।।
ভগবান স্কন্দ বললেন -
হে ব্রহ্মন্! শ্রীভাগবতের মাহাত্যকে বিস্তারে কে বলতে পারে? তবুও আমি এখন সংক্ষেপে বলছি, শ্রবণ করুন ।।৮।।
যিনি নিত্যা, সচ্চিদানন্দরূপিণী জগদম্বিকা, ভুক্তিমুক্তিপ্রদায়িনী তিনিই সেই ভাগবতে সাক্ষাত বিরাজমান ।।৯।।
অতএব মুনি! এই দেবীভাগবতকে দেবীর বাঙ্ময়ী মুর্তি বলা হয়। এর পঠন এবং শ্রবণ করিলে জগতের কিছুই দুর্লভ থাকে না ।।১০।।
শুনেছি বিবস্বানের পুত্র শ্রাদ্ধদেব ছিলেন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। বশিষ্ঠমুনির সম্মতিতে রাজা পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করিলেন ।।১১।।
মনুর দয়িতা শ্রদ্ধা হোতার নিকট প্রার্থনা করিলেন - "হে ব্রহ্মন্! আপনি যজ্ঞবিধিতে এমন কিছু উপায় করুন যাতে আমার কন্যা হয়।" ।।১২।।
তখন হোতা মনে 'কন্যা উদ্ভব হোক' এই চিন্তা করে যজ্ঞ করিলেন। এই ব্যভিচারের কারণে ইলা নামক কন্যা উৎপন্ন হল ।।১৩।।
অতএব রাজা সুতাকে দর্শন করে গুরুকে নিরাশ মনে জিজ্ঞাসা করিলেন - "হে প্রভু! আপনার সংকল্পে এমন বৈষম্য হল কেমন করে?" ।।১৪।।
এই শুনে মুনি(বশিষ্ঠ) ধ্যানস্ত হয়ে জ্ঞাত হলেন যে হোতা এই ব্যতিক্রমের কারণ। তখন ইলার জন্য পুরুষত্ব কামনা করে তিনি ঈশ্বরের শরণ গ্রহণ করিলেন ।।১৫।।
মুনির তপের প্রভাবে এবং পরেশানুগ্রহে সব লোকের মধ্যে ইলা দেখতে দেখতেই পুরুষরূপে পরিণত হল ।।১৬।।
সেই সময় গুরু সংস্কার করে তাঁর সুদ্যুম্ন নাম রাখিলেন। সেই মনুসুত এমন বিদ্যানিধি হল যেন সরিতা রূপি সাগর (অর্থাৎ তাঁর সাগরের সম বিদ্যা সরিতা রূপে প্রবাহিত হত) ।।১৭।।
কালক্রমে যখন সুদ্যুম্ন অরুণ(নবোদিত সূর্যের মত রূপ ও গুণ) হল, তখন সে মৃগার্থে (শিকার করিতে) তাঁর সৈন্ধ (অশ্বের এক প্রকার) অশ্বে আরূঢ় হয়ে বনে গমন করিলেন ।।১৮।।
সে তাঁর সাথীদের সহিত ভ্রমণ করিতে করিতে একের পর এক বহু বনে গমন করিল। দৈব ইচ্ছাতেই সেই কুমারেরা হিমাদ্রির নীচভাগে অবস্থিত এক বনে আসিল ।।১৯।।
কোন এক সময়ে এখানে ভার্যা অপর্ণা সহিত দেবাধিদেব ভগবান শঙ্কর আনন্দে রমণ করছিলেন ।।২০।।
তখন সেখানে শিবদর্শনলালসায় মুনিগণ আগমন করিলেন। তাঁদের দর্শন করে গিরিজা লজ্জিত হয়ে গেলেন ।।২১।।
গিরিশা সহিত তাঁহাকে রমন করিতে দেখে নিবৃত্ত সংশিতব্রতী মুনিগণ বৈকুণ্ঠে নিলয়ে গমন করিলেন ।।২২।।
প্রিয়ার প্রিয় মনের ইচ্ছা করে তিনি (মহাদেব) সেই অরণ্যকে অভিশাপ দিলেন - "এখন থেকে আরম্ভ করে যেই পুরুষ এখানে প্রবেশ করিবে সে স্ত্রীতে পরিণত হবে।" ।।২৩।।
তখন থেকে আরম্ভ করে সেই দেশে পুরুষেরা বর্জিত। সেখানে প্রবেশ করে সুদ্যুম্ন নারীশ্রেষ্ঠাতে পরিণত হল ।।২৪।।
তাঁর অনুগামীরা স্ত্রীতে তথা অশ্ব অশ্বীতে পরিণত হয়েছে দেখে সে (সুদ্যুম্ন) বিস্মিত হল। অতএব সেই সুন্দরী নারী বনে-বনে বিচরণ করিতে লাগিল ।।২৫।।
একবার তিনি বুধের আশ্রমের সান্নিধ্যে গমন করিলেন। ভগবান বুধ তাঁকে দর্শন করে, যিনি চারুসর্বাঙ্গী তথা যার পীনোন্নত পয়োধর, যিনি বিম্বোষ্ঠী, কুন্দদন্তী (কুন্দ পুষ্পের মত সুন্দর দাঁত), সুমুখী তথা উৎপলাক্ষী; অনঙ্গশর (কামদেবের বাণ) ভগবান বুধকে বিদ্ধাঙ্গ (মায়াশক্তির দ্বারা অঙ্গে আহত করে) করে তাঁর মনে কাম বাসনা উৎপন্ন করিল ।।২৬-২৭।।
তিনিও (ইলা) সেই সুভ্রূ কুমারকে, যিনি সোমনন্দন, কামনা করিলেন। তখন তিনি বুধের সহিত হাস্য (আনন্দ) করিয়া তাঁর আশ্রমে বাস করিতে লাগিলেন ।।২৮।।
অতএব কালক্রমে তিনি (বুধ) তাঁর থেকে, যিনি মিত্রাবরুণের কৃপায় জন্মেছিলেন (মনু পুত্রের জন্য মিত্রবরুণের যজ্ঞ করেছিল),পুরূরবা নামক এক পুত্র উৎপন্ন করিলেন ।।২৯।।
অতএব বুধাশ্রমে বহু বর্ষ ব্যতীত হয়ে গেল। কদাচিৎ তাঁর পূর্ববৃত্তান্ত মনে পরে গেল, তিনি দুঃখিত হয়ে (আশ্রম হইতে) গমন করিলেন ।।৩০।।
গুরুর আশ্রমে অতএব গমন করে তিনি বশিষ্ঠকে প্রণাম করিলেন। তাঁর বৃত্তান্ত নিবেদন করে তাঁর নিকট পুরুষত্ব প্রাপ্ত করার অভিপ্রায় প্রকট করে তাঁর শরণাপন্ন হলেন ।।৩১।।
সমস্ত বৃত্তান্ত জ্ঞাত হওয়ার পর বশিষ্ঠ পূর্বের মতন (পূর্বে যেমন ভগবান শিবের শরণাপন্ন হয়েছিলেন তেমন) কৈলাসে গমন করিলেন। (তিনি) পরম শম্ভুকে ভক্তিদ্বারা তুষ্ট করিবার জন্য পূজায় লীন হলেন ।।৩২।।
বশিষ্ঠ মুনি বললেন -
হে শিব, হে শঙ্কর, হে কপর্দিন আপনাকে প্রণাম। হে চন্দ্রমৌলী, আপনার অর্ধ অঙ্গে গিরিজা বিরাজ করে, আপনাকে প্রণাম ।।৩৩।।
হে মৃণ্ড, হে সুখদাতা, হে কৈলাসবাসী আপনাকে প্রণাম। হে নীলকণ্ঠ, আপনি ভক্তদের ভুক্তিমুক্তি প্রদান করেন, আপনাকে প্রণাম ।।৩৪।।
হে শিব, হে শিবরূপ, হে প্রপন্নভয়হারী আপনাকে প্রণাম। হে বৃষভবাহ, হে শরণ্য, হে পরাত্মা, আপনাকে প্রণাম ।।৩৫।।
আপনি সর্গ, স্থিতি ও লয়কালে ব্রহ্ম, বিষ্ণু এবং ঈশরূপ ধারণ করেন, আপনাকে প্রণাম। হে দেবাধিদেব, হে বরদ, হে পুরারি, আপনাকে প্রণাম ।।৩৬।।
হে যজ্ঞরূপ, আপনি যাচকের ফলদাতা, আপনাকে প্রণাম। হে গঙ্গাধর, সূর্য, ইন্দু তথা শিখা আপনার নেত্র, আপনাকে প্রণাম ।।৩৭।।
এই প্রকার স্তুতি করাতে জগৎপতি ভগবানের বৃষারূঢ়রূপে অম্বিকাসহ প্রাদুর্ভাব হল। তাঁর প্রভা কোটি সূর্য সম, তিনি রজতাচল সংকাশ (রজতাচল সদৃশ তাঁর স্বচ্ছ কান্তি), ত্রিলোচন, চন্দ্রশেখর। তিনি মুনিশ্রেষ্ঠর প্রণতিতে পরিতুষ্ট হয়ে বললেন ।।৩৮-৩৯।।
শ্রীভগবান বললেন -
হে বিপ্রর্ষি! আপনার মনে যা আছে সেই বর চান। ভগবানের এমন উক্তির পর বশিষ্ঠ মুনি তাঁকে প্রণাম করে অভ্যর্থনা করে ইলার পুরুষত্ব যাচনা করিলেন ।।৪০।।
অতএব ভগবান মুনিশ্রেষ্ঠকে প্রসন্ন হয়ে কহিলেন :- (ইলা) মাসে পুরুষ হবে তথা মাসে নারী হবে ।।৪১।।
এইভাবে শম্ভুর থেকে বর প্রাপ্ত করে হর্ষিত হয়ে (তিনি) বরদানোন্মুখী দেবী জগদম্বিকা মহেশ্বরীকে প্রণাম করিলেন ।।৪২।।
কোটি চন্দ্রকলা সম তাঁর কান্তি, তিনি সুস্মিতা। ইলার জন্য চিরপুরুষত্ব কামনা করে তিনি(বশিষ্ঠ) তাঁকে ভক্তিদ্বারা তুষ্ট করার জন্য পরিপূজন করিলেন ।।৪৩।।
জয় দেবী মহাদেবী ভক্তানুগ্রহকারিণি, জয় সর্বসুরারাধ্যা, জয় অনন্তগুণালয় ।।৪৪।।
নমো নমো দেবেশি, শরণাগতবৎসলা। জয় দুর্গে, দুঃখহন্ত্রি, দুষ্টদৈত্যসংহারিণী ।।৪৫।।
নমো ভক্তিগম্যে (যার নিকট ভক্তি দ্বারা গমন করা যায়), মহামায়ে, জগদম্বিকে। আপনার পদঅম্বুজ সংসার সাগর পার করার তরী ।।৪৬।।
ব্রহ্মা আদি জ্ঞানিও (আদি জ্ঞানি দেবগণও) আপনার পদঅম্বুজের সেবার দ্বারাই বিশ্বের সর্গস্থিতিলয়ের প্রভুত্ব লাভ করেন ।।৪৭।।
হে দেবেশি! আপনি চতুর্বর্গপ্রদায়িনি, আপনি প্রসন্না হওন। হে দেবী! আপনার স্তুতি করার ক্ষমতা কার আছে? আমি কেবল প্রণাম করছি ।।৪৮।।
এই স্তুতি করাতে ভগবতী দুর্গা যিনি পরা নারায়ণী, বশিষ্ঠ মুনির ভক্তিতে তৎক্ষণাৎ প্রসন্না হলেন ।।৪৯।।
তখন মহাদেবী, যিনি ভক্তের প্রতিকূল অবস্থাকে হরণ করেন, মুনিকে কহিলেন - সুদ্যুম্নের ভবনে গমন করে ভক্তিভরে আমার অর্চনা কর ।।৫০।।
হে দ্বিজোত্তম! তুমি সুদ্যুম্নকে প্রীতিপুর্বক নয় দিনে দেবী ভাগবত নামের আমার প্রিয় পুরাণ শুনাও ।।৫১।।
তাঁহা শ্রবণ করিলেই সতত সে পুরুষ হবে। এই উক্তি করে শিবেশ্বরী অন্তর্ধ্যান হয়ে গমন করিলেন ।।৫২।।
বশিষ্ঠ সেই দিশাকে নমন করে নিজ আশ্রমে সমাগম করিলেন। সুদ্যুম্নকে ডেকে দেবীর আরাধনা করার আদেশ দিলেন ।।৫৩।।
আশ্বিনের শুক্লপক্ষে নবরাত্র বিধিতে জগদম্বিকার পূজা করে ভূপতিকে (সুদ্যুম্নকে) (দেবী ভাগবত পুরাণ) শোনানো প্রারম্ভ করিলেন ।।৫৪।।
সুদ্যুম্নও ভক্তিভরে শ্রীমদ্ভাগবতামৃত শ্রবণ করিলেন। (তারপর) গুরুকে পূজা করে তথা প্রণাম করে চিরপুরুষত্ব লাভ করিলেন ।।৫৫।।
মহর্ষি বশিষ্ঠ (সুদ্যুম্নকে) রাজ্যাসনে অভিষিক্ত করিলেন। প্রজাকে প্রসন্ন করে তিনি ভুবনে ধর্ম দ্বারা শাসন করিলেন ।।৫৬।।
তিনি বিবিধ বরদক্ষিণাসম্পূর্ণ যজ্ঞ করিলেন। তারপর পুত্রগণের উপর রাজ্যের নির্দেশনা দিয়ে তিনি দেবীর লোককে প্রাপ্ত হলেন ।।৫৭।।
বিপ্রগণ, সেই ইতিহাসের কথা শেষ হল। মনুষ্য যদি ভক্তিসহ দেবীর প্রসাদ রূপী এই পরমামৃত পঠন বা শ্রবণ করে সে ইহলোকে সকল কামনা প্রাপ্ত হয় তথা অন্তে দেবীর লোকে গমন করে ।।৫৮।।
ইতি শ্রীস্কন্দপুরাণের মানসখণ্ডে শ্রীমদ্দেবীভাগবতমাহাত্যের তৃতীয়োধ্যায়
Chanti Path Chapter 1 শ্রীশ্রীদুর্গাসপ্তশতী প্রথম অধ্যায়
শ্রী চণ্ডী মাহাত্য
।। শ্রীদুর্গাকে প্রণাম ।।
শ্রীশ্রীদুর্গাসপ্তশতী
।। শ্রীদুর্গাকে প্রণাম ।।
শ্রীশ্রীদুর্গাসপ্তশতী
প্রথম অধ্যায়
মেধা ঋষি কর্তৃক রাজা সুরথ ও সমাধিকে ভগবতীর মহিমা বর্ণন প্রসঙ্গে মধুকৈটভ বধ সংবাদ
বিনিয়োগ :-
এই প্রথম চরিত্রের ব্রহ্মা ঋষি, মহাকালী দেবতা, গায়ত্রী ছন্দ, নন্দা শক্তি, রক্তদন্তিকা বীজ, অগ্নি তত্ত্ব এবং ঋগ্বেদ স্বরূপ। শ্রীমহাকালী দেবতার প্রীতির জন্য প্রথম চরিত্রের জপে বিনিয়োগ করা হয়।
এই প্রথম চরিত্রের ব্রহ্মা ঋষি, মহাকালী দেবতা, গায়ত্রী ছন্দ, নন্দা শক্তি, রক্তদন্তিকা বীজ, অগ্নি তত্ত্ব এবং ঋগ্বেদ স্বরূপ। শ্রীমহাকালী দেবতার প্রীতির জন্য প্রথম চরিত্রের জপে বিনিয়োগ করা হয়।
ধ্যান :-
ভগবান বিষ্ণু যোগনিদ্রায় থাকার সময় মধু এবং কৈটভকে বধের জন্য কমলজন্মা ব্রহ্মা যাঁকে স্তব করেছিলেন, সেই মহাকালী দেবীকে আমি সেবা(উপাসনা) করছি। তিনি নিজের দশ হাতে খড়্গ, চক্র, গদা, বাণ, ধনুষ, পরিঘ, শূল, ভুশুণ্ডি, নরমুণ্ড ও শঙ্খ ধারণ করেন। তাঁর তিনটী নেত্র। তিনি সর্বাঙ্গে দিব্য আভরণে ভূষিতা। তাঁর শরীরের জ্যোতি নীলকান্তমণির মত। তার দশটী মুখ ও দশটি পা ।।১।।
ঔং চণ্ডীকা দেবী কে প্রণাম
মহর্ষি মার্কেণ্ডেয় বললেন - ।।১।।
সূর্যপুত্র সাবর্ণি, যিনি অষ্টম মনু বলে কথিত, তাঁর উৎপত্তি(জন্মকাহিনী) কথা বিস্তারিতভাবে বলছি, শোনো ।।২।।
সূর্যতনয় মহাভাগ (মহাঐশ্বর্যশালী) সাবর্ণি ভগবতী মহামায়ার অনুগ্রহে যে ভাবে মন্বন্তরাধিপতি হয়েছিলেন, সেই প্রসঙ্গ শোনাচ্ছি ।।৩।।
পূর্বকালে স্বারোচিষ মন্বন্তরে সুরথ নামে এক রাজা ছিলেন, যিনি চৈত্রবংশে জন্মেছিলেন, তিনি সমগ্র ভূমণ্ডলের অধিপতি হয়েছিলেন ।।৪।।
তাঁর প্রজাদের তিনি নিজ ঔরসজাত পুত্রের মত নীতিশাস্ত্রমতে পালন করতেন; তবুও সেই সময় কোলাবিধ্বংসী নামক ক্ষত্রিয় তাঁর শত্রু হয়েছিল ।।৫।।
সুরথরাজার দণ্ডনীতি বড়ই প্রবল ছিল। শত্রুদের সাথে তাঁর যুদ্ধ হয়েছিল। কোলাবিধ্বংসীরা যদিও সংখ্যায় কম ছিল তবুও রাজা সুরথ যুদ্ধে পরাস্ত হয়েছিলেন ।।৬।।
তখন তিনি রণভুমি থেকে প্রত্যাগমন করে এসে কেবলমাত্র নিজের দেশের রাজা হয়ে থেকে গেলেন (সমগ্র পৃথিবী থেকে তাঁর অধিকার চলে যেতে থাকল), কিন্তু সেখানেও সেই প্রবল শত্রুরা সেই সময় এসে মহাভাগ রাজা সুরথকে আক্রমণ করল ।।৭।।
রাজার শক্তি কমে যাচ্ছিল; তার ফলে তাঁর দুষ্ট, বলবান এবং দুরাত্মা মন্ত্রীগণ সেই রাজধানীতেও রাজকীয় সৈন্যসামন্ত ও কোষাগার অধিকার করে নিল ।।৮।।
সুরথের প্রভুত্ব নষ্ট হয়ে যাওয়াতে তিনি মৃগয়ার উদ্দেশ্যে ঘোড়ায় চড়ে একলাই এক গভীর অরণ্যে গমন করলেন ।।৯।।
সেখানে তিনি দ্বিজবর মধা ঋষির আশ্রম দেখতে পেলেন, সেখানে হিংস্র জন্তুরাও নিজেদের স্বাভাবিক হিংসাবৃত্তি ত্যাগ করে পরস্পর শান্তভাবে বাস করত। মুনির অনেক শিষ্য সেই আশ্রমের শোভাবর্দ্বন করত ।।১০।।
সেখানে যাওয়ার পর তিনি মুনির দ্বারা সমাদুত হয়ে সেই মুনিবরের আশ্রমে ইতস্ততঃ ঘোরাফেরা করে কিছু সময় কাটালেন ।।১১।।
সেখানে মমতাভিভূত চিত্তে তিনি চিন্তা করতে লাগলেন - অতীতে আমার পূর্বপুরুষরা যে নগর সুরক্ষিত রেখেছিলেন, সেই নগর আজ আমার দ্বারা পরিত্যক্ত। আমার দুরাচারী ভৃত্যবর্গ সেই নগর ধর্মানুসারে বক্ষা করেছে কিনা জানি না, সর্বদা মদস্রবী ও মহাবল, আমার প্রধান হস্তী এখন শত্রুদের অধীন হয়ে কেমন সব ভোগ করছে। যে সব লোকেরা আমার অনুগ্রহ, বেতন, ভোজ্যদ্রব্যাদি পেয়ে সর্বদা আমার অনুগত ছিল, তারা নিশ্চয়ই এখন অন্য রাজাদের দাসত্ব করছে। বহুকষ্টে সঞ্চিত আমার সেই ধনরাশি ওই সব অমিতব্যয়ী আমাত্যদের দ্বারা নিয়ত ক্ষয় হতে হতে নিঃশেষ হয়ে যাবে। রাজা সুরথ সর্বদাই এই সমস্ত ঘটনা এবং অন্যান্য দুশ্চিন্তা করতেন। একদিন তিনি সেই দ্বিজবর মেধা মুনির আশ্রমের কাছে এক বৈশ্যকে দেখতে পেলেন এবং তাকে জিজ্ঞাসা করলেন - 'মহাশয়, তুমি কে? তুমি এখানে কেন এসেছ? তোমাকে যেন শোকাকুল ও মানসিক বেদনাযুক্ত বলে মনে হচ্ছে? রাজা সুরথের এই প্রীতিপূর্ণ সম্ভাষণে বিনয়াবনতভাবে সেই বৈশ্য রাজাকে প্রণাম করে প্রত্যুত্তরে বললেন - ।।১২-১৯।।
বৈশ্য বললেন - ।।২০।।
হে রাজন্! ধনবান বংশে জাত আমি এক বৈশ্য। আমার নাম সমাধি ।।২১।।
আমার দুষ্ট স্ত্রীপুত্রেরা ধনলোভে আমাকে বিতাড়িত করেছে। বর্তমানে আমি ধনসম্পত্তি ও স্ত্রীপুত্রাদির দ্বারা পরিত্যক্ত। আমার বিশ্বস্ত আত্মীয়স্বজনেরা আমার ধনসম্পত্তি আত্মসাৎ করে আমাকে পরিত্যাগ করেছে, এইজন্য দুঃখিত মনে আমি বনে চলে এসেছি। এখানে এসে আমি জানতেও পারছি না যে আমার স্ত্রীপুত্র এবং আত্মীয়-বন্ধুরা কুশলে আছে কিনা? বাড়ীতে এখন তারা কুশলে আছে না কষ্টে আছে কে জানে? ।।২২-২৪।।
আমার ছেলেরা কেমন আছে? তারা কি সদাচারী আছে না দুরাচারী হয়ে গেছে? ।।২৫।।
রাজা জিজ্ঞাসা করলেন - ।।২৬।।
যে সব লোভী স্ত্রীপুত্রগণ অর্থের লোভে তোমাকে ঘরছাড়া করেছে, তাদের জন্য তোমার মন এত স্নেহাসক্ত কেন? ।।২৭-২৮।।
বৈশ্য (সমাধি) বললেন - ।।২৯।।
আমার সম্বন্ধে আপনি যা বলছেন তা সবই ঠিক ।।৩০।।
কিন্তু কি করব, আমার মন তো নিষ্ঠুর হতে পারছে না। যারা অর্থের লোভে পিতৃস্নেহ, পতিপ্রেম ও স্বজনপ্রীতি জলাঞ্জলি দিয়ে আমাকে বহিস্কৃত করেছে তাদের প্রতিই আমার মন অনুরক্ত হচ্ছে। হে মহামতি! গুণহীন (স্নেহহীন) বন্ধুদের প্রতিও যে আমার মন এই রকম মমতাযুক্ত হচ্ছে, এর কারণ কি? আমি তো বুঝেও বুঝতে পারছি না। তাদের জন্য আমার দীর্ঘশ্বাস পড়ছে এবং অত্যন্ত দুশ্চিন্তা হচ্ছে ।।৩১-৩৩।।
ওরা প্রীতিহীন, তবুও যে ওদের প্রতি আমি নির্দয় হতে পারছি না। আমি কি করব? ।।৩৪।।
মার্কেণ্ডেয় মুনি বললেন - ।।৩৫।।
হে ব্রহ্মন্! তখন রাজশ্রেষ্ঠ সুরথ এবং সেই সমাধি নামক বৈশ্য দুজনে একসাথে মেধা ঋষির কাছে গিয়ে যথাযোগ্য বিনীত প্রণাম করে তাঁর সামনে বসলেন। তারপর সেই বৈশ্য এবং রাজা কিছু কথাবার্তা শুরু করলেন ।।৩৬-৩৮।।
রাজা বললেন - ।।৩৯।।
হে ভগবন্! আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করি। অনুগ্রহ করে তার উত্তর আমাকে বলুন ।।৪০।।
আমার মন আমার নিজের বশীভূত না থাকায় এই প্রশ্ন সর্বদাই আমাকে দুঃখ দিচ্ছে। যে রাজ্য আমার হাতের বাহিরে চলে গেছে সেই রাজ্যের প্রতি এবং তার সব কিছুর প্রতি আমার মমতা বদ্ধ হয়ে রয়েছে ।।৪১।।
হে মুনিসত্তম! সেই রাজ্য যে আমার আর নেই তা জানা সত্ত্বেও অজ্ঞানীর মত সেই রাজা এবং রাজ্যের বিভিন্ন বস্তুর জন্য আমার মন বিষাদগ্রস্ত, এর কারণ কি? এখানে এই বৈশ্যও স্ত্রীপুত্রদের দ্বারা বাড়ী থেকে বিতাড়িত, অপমানিত হয়ে এসেছেন। পুত্র, স্ত্রী এবং ভৃত্যেরা একে ছেড়ে গেছে ।।৪২।।
স্বজনরাও তাকে পরিত্যাগ করেছে, তবুও তাদের প্রতি এই বৈশ্য অতিশয় আসক্ত। এই পরিস্থিতিতে ইনি এবং আমি দুজনেই অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে রয়েছি ।।৪৩।।
যেখানে যে ব্যাপারে আমরা প্রত্যক্ষভাবে দোষ দেখতে পাচ্ছি, সেই বিষয়ের প্রতিও আমাদের মনে মমতাজনিত আকর্ষণ জন্মাচ্ছে। হে মহাভাগ! আমরা দুজনেই বুদ্ধিমান তথাপিও আমাদের মনে যে মোহ উৎপন্ন হয়েছে, এটা কেন? বিবেকহীন মানুষের মত এই রকম মূঢ়তা, আমার এবং এর মধ্যেও কেন? ।।৪৪-৪৫।।
ঋষি বললেন - ।।৪৬।।
হে মহামতে! সব প্রাণীরই রূপ, রস প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ে জ্ঞান আছে ।।৪৭।।
এইরকম বিষয়সমূহও প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা, কোনও প্রাণী দিনের বেলায় দেখতে পায় না, তাই সে রূপএর বিষয়ে দিনের বেলায় অজ্ঞান, আবার কোনও প্রাণী রাতের বেলা দেখতে পায় না, সে রাত্রিবেলা রূপের বিষয়ে অজ্ঞান ।।৪৮।।
আবার কিছু প্রাণী আছে যারা দিনে ও রাত্রে একই রকমভাবে দেখতে পায়, একথা সত্যি যে মানুষ জ্ঞানবান্ কিন্তু মানুষই কেবল এরকম নয় ।।৪৯।।
পশু, পাখী, মৃগ ইত্যাদি সব প্রাণীরই বিষয়জ্ঞান আছে। মানুষের জ্ঞানও পশুপাখীদের বিষয়জ্ঞানের মত ।।৫০।।
আবার মানুষেরও যেরকম বিষয়জ্ঞান পশুপাখীদেরও তেমনই। এই বিষয়জ্ঞান তথা অন্যান্য ব্যাপারেও উভয়েরই জ্ঞান সমান সমান। দেখ, জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও পাখীরা নিজে ক্ষুধার্থ হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র মোহের বশে নিজের বাচ্চাদের মুখে খাবারের দানা দিয়ে দেয়। হে নরশ্রেষ্ঠ! দেখলেই বুঝতে পারবে যে মানুষ জ্ঞানী হয়েও শুধুমাত্র লোভের বশে প্রত্যুপকারের আশায় পুত্রসন্তানদের কামনা করে? যদিও এদের কারুর মধ্যেই জ্ঞানের অভাব নেই তবুও সংসারের স্থিতিকারিণী (জন্ম-মৃত্যুপরম্পরা) ভগবতী মহামায়ার প্রভাবে এরা সকলে মমতারূপ আবর্তযুক্ত মোহরূপ গর্তে পড়ে আছে। অতএব এই ব্যাপারে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। জগৎপতি ভগবান বিষ্ণুর যোগনিদ্রারূপা যে ভগবতী মহামায়া, তাঁর দ্বারাই এই জগৎ মোহিত হয়ে রয়েছে। সেই ভগবতী দেবী মহামায়া জ্ঞানীদের চিত্তকে বলপূর্বক আকর্ষণ করে মোহাবৃত করেন। তিনিই এই সম্পূর্ণ চরাচর জগৎ সৃষ্টি করেন, আবার তিনিই প্রসন্না হলে মানুষকে মুক্তিলাভের জন্য বরদান করেন। তিনিই সংসার বন্ধন ও মোক্ষের কারণস্বরূপা পরাবিদ্যা ও সনাতনী (অন্তবিহীনা) দেবী তথা ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরাদি সকল ঈশ্বরের ঈশ্বরী ।।৫১-৫৮।।
রাজা সুরথ জিজ্ঞাসা করলেন - ।।৫৯।।
হে ভগবন্! যাঁকে আপনি মহামায়া বলছেন, সেই দেবী কে? ব্রহ্মন্! তিনি কিরূপে আবির্ভূতা হয়েছেন? তাঁর চরিত্র কিরকম? হে ব্রহ্মবেত্তাগণের মধ্যে শ্রষ্ঠ! সেই দেবীর যেরূপ স্বভাব, তাঁর যা স্বরূপ এবং তিনি যেভাবে উৎপন্না হয়েছেন, সেই সবকিছু আপনার শ্রীমুখ থেকে আমরা শুনতে ইচ্ছা করি ।।৬০-৬২।।
মেধা ঋষি বললেন - ।।৬৩।।
হে রাজন্! প্রকৃতপক্ষে তো তিনি নিত্যস্বরূপাই। সমগ্র জগৎপ্রপঞ্চ তাঁরই মুর্তিস্বরূপ। তিনি সর্বব্যাপিনী। তথাপি তাঁর আবির্ভাব বহুপ্রকারে হয়ে থাকে। সেইসব কাহিনী আমার কাছে শোন। তিনি যদিও নিত্যা এবং জন্মমৃত্যুরহিতা, তবুও দেবতাদের কার্যসিদ্ধির জন্য যখন তিনি প্রকট হন তখন লোকে তাঁকে উৎপন্না বলে থাকে। কল্পান্তে (প্রলয়কালে) সমগ্র জগৎ যখন একার্ণব জলে নিমগ্ন হল আর সকলের প্রভু ভগবান বিষ্ণু শেষনাগকে শয্যারূপে বিস্তৃত করে যোগনিদ্রাকে আশ্রয় করে শুয়ে ছিলেন, সেই সময় তাঁর কর্ণমল থেকে মধু ও কৈটভনামে দুই ভয়ঙ্কর অসুর উৎপন্ন হল। তারা দুজনে মিলে ব্রহ্মাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। ভগবান বিষ্ণুর নাভিকমলে বিরাজমান প্রজাপতি ব্রহ্মা সেই দুই ভীষণ অসুরকে প্রত্যক্ষ দেখে এবং ভগবান বিষ্ণুকে নিদ্রিত দেখে, একাগ্রচিত্তে ভগবান বিষ্ণুকে জাগাবার উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁর চোখে নিবাসিনী যোগনিদ্রার স্তব করতে লাগলেন। এই বিশ্বের জগদীশ্বরী, জগদ্ধাত্রী, স্থিতিসংহারকারিণী এবং তেজঃস্বরূপ ভগবান বিষ্ণুর অনুপম শক্তি, সেই ভগবতী নিদ্রাদেবীকে ভগবান ব্রহ্মা স্তুতি করতে লাগলেন ।।৬৪-৭১।।
ব্রহ্মা বললেন - ।।৭২।।
দেবী! তুমি স্বাহা, তুমি স্বধা এবং তুমিই বষট্কার স্বরও তোমারই স্বরূপ। তুমিই জীবনদায়িনী সুধা। নিত্য অক্ষর প্রণবের অকার, উকার, মকার - এই তিনমাত্রারূপে তুমিই স্থিত, আবার এই তিন মাত্রা ছাড়া বিন্দুরূপা যে নিত্য অর্দ্ধমাত্রা - যাকে বিশেষরূপে আলাদাভাবে উচ্চারণ করা যায় না, তাও তুমিই। দেবি! তুমিই সন্ধ্যা, সাবিত্রী তথা পরম জননী। দেবি! তুমিই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ধারণ করে আছ। তোমার থেকেই এই জগতের সৃষ্টি হয়। তোমার দ্বারাই এই জগতের পালন হয় এবং সর্বদা প্রলয়কালে তুমিই এর সংহার কর। জগন্ময়ী দেবী! এই জগতের সৃষ্টিকালে তুমি সৃষ্টিরূপা, পালনকালে স্থিতিরূপা এবং প্রলয়কালে সংহারশক্তিরূপা। তুমিই মহাবিদ্যা, মহামায়া, মহামেধা, মহাস্মৃতি, মহামোহরূপা, মহাদেবী ও মহাসুরী। তুমিই সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনগুণের সৃষ্টিকারিণী সর্বময়ী প্রকৃতি। ভয়ঙ্কর কালরাত্রি, মহারাত্রি ও মোহরাত্রিও তুমিই। তুমিই শ্রী, তুমিই ঈশ্বরী, তুমিই হ্রী এবং তুমি নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি। লজ্জা, পুষ্টি, তুষ্টি, শান্তি ও ক্ষমাও তুমিই। তুমি খড়্গধারিণী, শূলধারিণী, ঘোররূপা, তথা গদা, চক্র, শঙ্খ ও ধুনর্ধারিণী। বাণ, ভুশুণ্ডী ও পরিঘা - এসবও তোমার অস্ত্র। তুমি সৌম্যা ও সৌম্যতরা - শুধু তাই নয়, যত কিছু সৌম্য এবং সুন্দর পদার্থ আছে, সেই সবের থেকেও তুমি অত্যধিক সুন্দরী, পর ও অপর - সবের উপরে পরমেশ্বরী তুমিই। হে বিশ্বরূপিণী, যে-কোনও স্থানে যাহা কিছু চেতন বা জড় বস্তু অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতে হইবে সেই সকলের যে শক্তি, তাহা তুমিই। সুতরাং কিরূপে তোমার স্তব করিব? (বিশ্বপ্রপঞ্চে তুমি ভিন্ন যখন আর কিছুই নাই, তখন তোমার স্তব কিরূপে সম্ভব?)। যেই ভগবান এই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও পালন করেন, সেই ভগবানকেও যখন তুমি নিদ্রাবিষ্ট করে রেখেছ, তখন কে তোমার স্তব করতে সমর্থ? আমাকে, ভগবান বিষ্ণুকে ও ভগবান রুদ্রকেও তুমিই শরীর গ্রহণ করিয়েছ; কাজেই তোমার স্তুতি করার মত শক্তি কার আছে? হে দেবি! তুমি তো নিজের এই উদর প্রভাবের দ্বারাই প্রশংসিত। এই যে দুই দুর্জয় অসুর মধু ও কৈটভ এদের তুমি মোহগ্রস্ত করে দাও এবং জগদীশ্বর ভগবান বিষ্ণুকে শীগগিরই জাগরিত করে দাও। সঙ্গে সঙ্গে এই মহাসুরকে বধ করবার জন্য তাঁর প্রবৃত্তি উৎপাদন কর ।।৭৩-৮৭।।
মেধা ঋষি বললেন - ।।৮৮।।
ব্রহ্মা যখন মধু আর কৈটভকে বধ করবার উদ্দেশ্যে ভগবান বিষ্ণুকে যোগনিদ্রা থেকে জাগাবার জন্য তমোগুণের অধিষ্ঠাত্রী দেবী যোগনিদ্রার এই রকম স্তুতি করলেন, তখন সেই দেবী যোগনিদ্রা ভগবান বিষ্ণুর চোখ, মুখ, নাক, বাহু, হৃদয় এবং বক্ষঃস্থল থেকে নিগত হয়ে অব্যক্ত জন্মা ব্রহ্মার দৃষ্টিগোচর হলেন। যোগনিদ্রা ভেঙ্গে যাওয়ার পর জগন্নাথ ভগবান জনার্দন একীভূত মহাসমুদ্রে অবস্থিত অনন্তশয়ান থেকে জেগে উঠলেন। গাত্রোত্থান করে তিনি ওই দুই অসুরকে দেখলেন। তারা, সেই দুরাত্মা, অতি বলবান ও মহাবিক্রমশালী ক্রোধে আরক্ত নয়নে ব্রহ্মাকে ভক্ষণের উদ্যোগ করছিল। অতঃপর ভগবান শ্রীহরি শয্যা ছেড়ে উঠে ওই দুই অসুরের সাথে পাঁচ হাজার বছর ধরে বাহুযুদ্ধ করলেন, ওরা দুজনও অত্যন্ত বলদর্পিত হয়েছিল। এদিকে দেবী মহামায়াও তাদের বিমোহিত করে রেখেছিলেন; ফলে তারা ভগবান বিষ্ণুকে বলল - 'আমরা তোমার বীরত্বে সন্তুষ্ট হয়েছি, তুমি আমাদের কাছে বর প্রার্থনা কর। ' ।।৮৯-৯৫।।
শ্রীভগবান বললেন - ।।৯৬।।
তোমরা দুজনে যদি আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে থাক, তবে তোমরা আমার হাতে বধ্য হও। ব্যস্, এইই আমার একান্ত অভিপ্রায়। অন্য বরের আর কি প্রয়োজন? ।।৯৭-৯৮।।
মেধা ঋষি বললেন - ।।৯৯।।
এইভাবে প্রবঞ্চিত হয়ে যখন তারা সমস্ত জগৎ জলমগ্ন দেখলো, তখন কমলনয়ন ভগবানকে বলল - পৃথিবীর যে জায়গাটা জলমগ্ন হয়নি যেখানে শুকনো জায়গা আছে, সেইস্থানে আমাদের বধ কর ।।১০০-১০১।।
মেধা ঋষি বললেন - ।।১০২।।
শঙ্খ, চক্র ও গদাধারী ভগবান বিষ্ণু 'তাই হোক' বলে ওদের দুজনের মাথা দুটি নিজের ঊরুর ওপর রেখে চক্র দিয়ে ছেদন করলেন। এইভাবে এই দেবী মহামায়া ব্রহ্মা কর্তৃক সংস্তুতা হয়ে স্বয়ং আবির্ভূতা হয়েছিলেন। আমি আবার তোমাদের কাছে এই দেবীর মহিমা বা আবির্ভাবের বিষয় বর্ণনা করছি, শোন ।।১০০-১০৪।।
ভগবান বিষ্ণু যোগনিদ্রায় থাকার সময় মধু এবং কৈটভকে বধের জন্য কমলজন্মা ব্রহ্মা যাঁকে স্তব করেছিলেন, সেই মহাকালী দেবীকে আমি সেবা(উপাসনা) করছি। তিনি নিজের দশ হাতে খড়্গ, চক্র, গদা, বাণ, ধনুষ, পরিঘ, শূল, ভুশুণ্ডি, নরমুণ্ড ও শঙ্খ ধারণ করেন। তাঁর তিনটী নেত্র। তিনি সর্বাঙ্গে দিব্য আভরণে ভূষিতা। তাঁর শরীরের জ্যোতি নীলকান্তমণির মত। তার দশটী মুখ ও দশটি পা ।।১।।
ঔং চণ্ডীকা দেবী কে প্রণাম
মহর্ষি মার্কেণ্ডেয় বললেন - ।।১।।
সূর্যপুত্র সাবর্ণি, যিনি অষ্টম মনু বলে কথিত, তাঁর উৎপত্তি(জন্মকাহিনী) কথা বিস্তারিতভাবে বলছি, শোনো ।।২।।
সূর্যতনয় মহাভাগ (মহাঐশ্বর্যশালী) সাবর্ণি ভগবতী মহামায়ার অনুগ্রহে যে ভাবে মন্বন্তরাধিপতি হয়েছিলেন, সেই প্রসঙ্গ শোনাচ্ছি ।।৩।।
পূর্বকালে স্বারোচিষ মন্বন্তরে সুরথ নামে এক রাজা ছিলেন, যিনি চৈত্রবংশে জন্মেছিলেন, তিনি সমগ্র ভূমণ্ডলের অধিপতি হয়েছিলেন ।।৪।।
তাঁর প্রজাদের তিনি নিজ ঔরসজাত পুত্রের মত নীতিশাস্ত্রমতে পালন করতেন; তবুও সেই সময় কোলাবিধ্বংসী নামক ক্ষত্রিয় তাঁর শত্রু হয়েছিল ।।৫।।
সুরথরাজার দণ্ডনীতি বড়ই প্রবল ছিল। শত্রুদের সাথে তাঁর যুদ্ধ হয়েছিল। কোলাবিধ্বংসীরা যদিও সংখ্যায় কম ছিল তবুও রাজা সুরথ যুদ্ধে পরাস্ত হয়েছিলেন ।।৬।।
তখন তিনি রণভুমি থেকে প্রত্যাগমন করে এসে কেবলমাত্র নিজের দেশের রাজা হয়ে থেকে গেলেন (সমগ্র পৃথিবী থেকে তাঁর অধিকার চলে যেতে থাকল), কিন্তু সেখানেও সেই প্রবল শত্রুরা সেই সময় এসে মহাভাগ রাজা সুরথকে আক্রমণ করল ।।৭।।
রাজার শক্তি কমে যাচ্ছিল; তার ফলে তাঁর দুষ্ট, বলবান এবং দুরাত্মা মন্ত্রীগণ সেই রাজধানীতেও রাজকীয় সৈন্যসামন্ত ও কোষাগার অধিকার করে নিল ।।৮।।
সুরথের প্রভুত্ব নষ্ট হয়ে যাওয়াতে তিনি মৃগয়ার উদ্দেশ্যে ঘোড়ায় চড়ে একলাই এক গভীর অরণ্যে গমন করলেন ।।৯।।
সেখানে তিনি দ্বিজবর মধা ঋষির আশ্রম দেখতে পেলেন, সেখানে হিংস্র জন্তুরাও নিজেদের স্বাভাবিক হিংসাবৃত্তি ত্যাগ করে পরস্পর শান্তভাবে বাস করত। মুনির অনেক শিষ্য সেই আশ্রমের শোভাবর্দ্বন করত ।।১০।।
সেখানে যাওয়ার পর তিনি মুনির দ্বারা সমাদুত হয়ে সেই মুনিবরের আশ্রমে ইতস্ততঃ ঘোরাফেরা করে কিছু সময় কাটালেন ।।১১।।
সেখানে মমতাভিভূত চিত্তে তিনি চিন্তা করতে লাগলেন - অতীতে আমার পূর্বপুরুষরা যে নগর সুরক্ষিত রেখেছিলেন, সেই নগর আজ আমার দ্বারা পরিত্যক্ত। আমার দুরাচারী ভৃত্যবর্গ সেই নগর ধর্মানুসারে বক্ষা করেছে কিনা জানি না, সর্বদা মদস্রবী ও মহাবল, আমার প্রধান হস্তী এখন শত্রুদের অধীন হয়ে কেমন সব ভোগ করছে। যে সব লোকেরা আমার অনুগ্রহ, বেতন, ভোজ্যদ্রব্যাদি পেয়ে সর্বদা আমার অনুগত ছিল, তারা নিশ্চয়ই এখন অন্য রাজাদের দাসত্ব করছে। বহুকষ্টে সঞ্চিত আমার সেই ধনরাশি ওই সব অমিতব্যয়ী আমাত্যদের দ্বারা নিয়ত ক্ষয় হতে হতে নিঃশেষ হয়ে যাবে। রাজা সুরথ সর্বদাই এই সমস্ত ঘটনা এবং অন্যান্য দুশ্চিন্তা করতেন। একদিন তিনি সেই দ্বিজবর মেধা মুনির আশ্রমের কাছে এক বৈশ্যকে দেখতে পেলেন এবং তাকে জিজ্ঞাসা করলেন - 'মহাশয়, তুমি কে? তুমি এখানে কেন এসেছ? তোমাকে যেন শোকাকুল ও মানসিক বেদনাযুক্ত বলে মনে হচ্ছে? রাজা সুরথের এই প্রীতিপূর্ণ সম্ভাষণে বিনয়াবনতভাবে সেই বৈশ্য রাজাকে প্রণাম করে প্রত্যুত্তরে বললেন - ।।১২-১৯।।
বৈশ্য বললেন - ।।২০।।
হে রাজন্! ধনবান বংশে জাত আমি এক বৈশ্য। আমার নাম সমাধি ।।২১।।
আমার দুষ্ট স্ত্রীপুত্রেরা ধনলোভে আমাকে বিতাড়িত করেছে। বর্তমানে আমি ধনসম্পত্তি ও স্ত্রীপুত্রাদির দ্বারা পরিত্যক্ত। আমার বিশ্বস্ত আত্মীয়স্বজনেরা আমার ধনসম্পত্তি আত্মসাৎ করে আমাকে পরিত্যাগ করেছে, এইজন্য দুঃখিত মনে আমি বনে চলে এসেছি। এখানে এসে আমি জানতেও পারছি না যে আমার স্ত্রীপুত্র এবং আত্মীয়-বন্ধুরা কুশলে আছে কিনা? বাড়ীতে এখন তারা কুশলে আছে না কষ্টে আছে কে জানে? ।।২২-২৪।।
আমার ছেলেরা কেমন আছে? তারা কি সদাচারী আছে না দুরাচারী হয়ে গেছে? ।।২৫।।
রাজা জিজ্ঞাসা করলেন - ।।২৬।।
যে সব লোভী স্ত্রীপুত্রগণ অর্থের লোভে তোমাকে ঘরছাড়া করেছে, তাদের জন্য তোমার মন এত স্নেহাসক্ত কেন? ।।২৭-২৮।।
বৈশ্য (সমাধি) বললেন - ।।২৯।।
আমার সম্বন্ধে আপনি যা বলছেন তা সবই ঠিক ।।৩০।।
কিন্তু কি করব, আমার মন তো নিষ্ঠুর হতে পারছে না। যারা অর্থের লোভে পিতৃস্নেহ, পতিপ্রেম ও স্বজনপ্রীতি জলাঞ্জলি দিয়ে আমাকে বহিস্কৃত করেছে তাদের প্রতিই আমার মন অনুরক্ত হচ্ছে। হে মহামতি! গুণহীন (স্নেহহীন) বন্ধুদের প্রতিও যে আমার মন এই রকম মমতাযুক্ত হচ্ছে, এর কারণ কি? আমি তো বুঝেও বুঝতে পারছি না। তাদের জন্য আমার দীর্ঘশ্বাস পড়ছে এবং অত্যন্ত দুশ্চিন্তা হচ্ছে ।।৩১-৩৩।।
ওরা প্রীতিহীন, তবুও যে ওদের প্রতি আমি নির্দয় হতে পারছি না। আমি কি করব? ।।৩৪।।
মার্কেণ্ডেয় মুনি বললেন - ।।৩৫।।
হে ব্রহ্মন্! তখন রাজশ্রেষ্ঠ সুরথ এবং সেই সমাধি নামক বৈশ্য দুজনে একসাথে মেধা ঋষির কাছে গিয়ে যথাযোগ্য বিনীত প্রণাম করে তাঁর সামনে বসলেন। তারপর সেই বৈশ্য এবং রাজা কিছু কথাবার্তা শুরু করলেন ।।৩৬-৩৮।।
রাজা বললেন - ।।৩৯।।
হে ভগবন্! আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করি। অনুগ্রহ করে তার উত্তর আমাকে বলুন ।।৪০।।
আমার মন আমার নিজের বশীভূত না থাকায় এই প্রশ্ন সর্বদাই আমাকে দুঃখ দিচ্ছে। যে রাজ্য আমার হাতের বাহিরে চলে গেছে সেই রাজ্যের প্রতি এবং তার সব কিছুর প্রতি আমার মমতা বদ্ধ হয়ে রয়েছে ।।৪১।।
হে মুনিসত্তম! সেই রাজ্য যে আমার আর নেই তা জানা সত্ত্বেও অজ্ঞানীর মত সেই রাজা এবং রাজ্যের বিভিন্ন বস্তুর জন্য আমার মন বিষাদগ্রস্ত, এর কারণ কি? এখানে এই বৈশ্যও স্ত্রীপুত্রদের দ্বারা বাড়ী থেকে বিতাড়িত, অপমানিত হয়ে এসেছেন। পুত্র, স্ত্রী এবং ভৃত্যেরা একে ছেড়ে গেছে ।।৪২।।
স্বজনরাও তাকে পরিত্যাগ করেছে, তবুও তাদের প্রতি এই বৈশ্য অতিশয় আসক্ত। এই পরিস্থিতিতে ইনি এবং আমি দুজনেই অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে রয়েছি ।।৪৩।।
যেখানে যে ব্যাপারে আমরা প্রত্যক্ষভাবে দোষ দেখতে পাচ্ছি, সেই বিষয়ের প্রতিও আমাদের মনে মমতাজনিত আকর্ষণ জন্মাচ্ছে। হে মহাভাগ! আমরা দুজনেই বুদ্ধিমান তথাপিও আমাদের মনে যে মোহ উৎপন্ন হয়েছে, এটা কেন? বিবেকহীন মানুষের মত এই রকম মূঢ়তা, আমার এবং এর মধ্যেও কেন? ।।৪৪-৪৫।।
ঋষি বললেন - ।।৪৬।।
হে মহামতে! সব প্রাণীরই রূপ, রস প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ে জ্ঞান আছে ।।৪৭।।
এইরকম বিষয়সমূহও প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা, কোনও প্রাণী দিনের বেলায় দেখতে পায় না, তাই সে রূপএর বিষয়ে দিনের বেলায় অজ্ঞান, আবার কোনও প্রাণী রাতের বেলা দেখতে পায় না, সে রাত্রিবেলা রূপের বিষয়ে অজ্ঞান ।।৪৮।।
আবার কিছু প্রাণী আছে যারা দিনে ও রাত্রে একই রকমভাবে দেখতে পায়, একথা সত্যি যে মানুষ জ্ঞানবান্ কিন্তু মানুষই কেবল এরকম নয় ।।৪৯।।
পশু, পাখী, মৃগ ইত্যাদি সব প্রাণীরই বিষয়জ্ঞান আছে। মানুষের জ্ঞানও পশুপাখীদের বিষয়জ্ঞানের মত ।।৫০।।
আবার মানুষেরও যেরকম বিষয়জ্ঞান পশুপাখীদেরও তেমনই। এই বিষয়জ্ঞান তথা অন্যান্য ব্যাপারেও উভয়েরই জ্ঞান সমান সমান। দেখ, জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও পাখীরা নিজে ক্ষুধার্থ হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র মোহের বশে নিজের বাচ্চাদের মুখে খাবারের দানা দিয়ে দেয়। হে নরশ্রেষ্ঠ! দেখলেই বুঝতে পারবে যে মানুষ জ্ঞানী হয়েও শুধুমাত্র লোভের বশে প্রত্যুপকারের আশায় পুত্রসন্তানদের কামনা করে? যদিও এদের কারুর মধ্যেই জ্ঞানের অভাব নেই তবুও সংসারের স্থিতিকারিণী (জন্ম-মৃত্যুপরম্পরা) ভগবতী মহামায়ার প্রভাবে এরা সকলে মমতারূপ আবর্তযুক্ত মোহরূপ গর্তে পড়ে আছে। অতএব এই ব্যাপারে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। জগৎপতি ভগবান বিষ্ণুর যোগনিদ্রারূপা যে ভগবতী মহামায়া, তাঁর দ্বারাই এই জগৎ মোহিত হয়ে রয়েছে। সেই ভগবতী দেবী মহামায়া জ্ঞানীদের চিত্তকে বলপূর্বক আকর্ষণ করে মোহাবৃত করেন। তিনিই এই সম্পূর্ণ চরাচর জগৎ সৃষ্টি করেন, আবার তিনিই প্রসন্না হলে মানুষকে মুক্তিলাভের জন্য বরদান করেন। তিনিই সংসার বন্ধন ও মোক্ষের কারণস্বরূপা পরাবিদ্যা ও সনাতনী (অন্তবিহীনা) দেবী তথা ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরাদি সকল ঈশ্বরের ঈশ্বরী ।।৫১-৫৮।।
রাজা সুরথ জিজ্ঞাসা করলেন - ।।৫৯।।
হে ভগবন্! যাঁকে আপনি মহামায়া বলছেন, সেই দেবী কে? ব্রহ্মন্! তিনি কিরূপে আবির্ভূতা হয়েছেন? তাঁর চরিত্র কিরকম? হে ব্রহ্মবেত্তাগণের মধ্যে শ্রষ্ঠ! সেই দেবীর যেরূপ স্বভাব, তাঁর যা স্বরূপ এবং তিনি যেভাবে উৎপন্না হয়েছেন, সেই সবকিছু আপনার শ্রীমুখ থেকে আমরা শুনতে ইচ্ছা করি ।।৬০-৬২।।
মেধা ঋষি বললেন - ।।৬৩।।
হে রাজন্! প্রকৃতপক্ষে তো তিনি নিত্যস্বরূপাই। সমগ্র জগৎপ্রপঞ্চ তাঁরই মুর্তিস্বরূপ। তিনি সর্বব্যাপিনী। তথাপি তাঁর আবির্ভাব বহুপ্রকারে হয়ে থাকে। সেইসব কাহিনী আমার কাছে শোন। তিনি যদিও নিত্যা এবং জন্মমৃত্যুরহিতা, তবুও দেবতাদের কার্যসিদ্ধির জন্য যখন তিনি প্রকট হন তখন লোকে তাঁকে উৎপন্না বলে থাকে। কল্পান্তে (প্রলয়কালে) সমগ্র জগৎ যখন একার্ণব জলে নিমগ্ন হল আর সকলের প্রভু ভগবান বিষ্ণু শেষনাগকে শয্যারূপে বিস্তৃত করে যোগনিদ্রাকে আশ্রয় করে শুয়ে ছিলেন, সেই সময় তাঁর কর্ণমল থেকে মধু ও কৈটভনামে দুই ভয়ঙ্কর অসুর উৎপন্ন হল। তারা দুজনে মিলে ব্রহ্মাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। ভগবান বিষ্ণুর নাভিকমলে বিরাজমান প্রজাপতি ব্রহ্মা সেই দুই ভীষণ অসুরকে প্রত্যক্ষ দেখে এবং ভগবান বিষ্ণুকে নিদ্রিত দেখে, একাগ্রচিত্তে ভগবান বিষ্ণুকে জাগাবার উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁর চোখে নিবাসিনী যোগনিদ্রার স্তব করতে লাগলেন। এই বিশ্বের জগদীশ্বরী, জগদ্ধাত্রী, স্থিতিসংহারকারিণী এবং তেজঃস্বরূপ ভগবান বিষ্ণুর অনুপম শক্তি, সেই ভগবতী নিদ্রাদেবীকে ভগবান ব্রহ্মা স্তুতি করতে লাগলেন ।।৬৪-৭১।।
ব্রহ্মা বললেন - ।।৭২।।
দেবী! তুমি স্বাহা, তুমি স্বধা এবং তুমিই বষট্কার স্বরও তোমারই স্বরূপ। তুমিই জীবনদায়িনী সুধা। নিত্য অক্ষর প্রণবের অকার, উকার, মকার - এই তিনমাত্রারূপে তুমিই স্থিত, আবার এই তিন মাত্রা ছাড়া বিন্দুরূপা যে নিত্য অর্দ্ধমাত্রা - যাকে বিশেষরূপে আলাদাভাবে উচ্চারণ করা যায় না, তাও তুমিই। দেবি! তুমিই সন্ধ্যা, সাবিত্রী তথা পরম জননী। দেবি! তুমিই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ধারণ করে আছ। তোমার থেকেই এই জগতের সৃষ্টি হয়। তোমার দ্বারাই এই জগতের পালন হয় এবং সর্বদা প্রলয়কালে তুমিই এর সংহার কর। জগন্ময়ী দেবী! এই জগতের সৃষ্টিকালে তুমি সৃষ্টিরূপা, পালনকালে স্থিতিরূপা এবং প্রলয়কালে সংহারশক্তিরূপা। তুমিই মহাবিদ্যা, মহামায়া, মহামেধা, মহাস্মৃতি, মহামোহরূপা, মহাদেবী ও মহাসুরী। তুমিই সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনগুণের সৃষ্টিকারিণী সর্বময়ী প্রকৃতি। ভয়ঙ্কর কালরাত্রি, মহারাত্রি ও মোহরাত্রিও তুমিই। তুমিই শ্রী, তুমিই ঈশ্বরী, তুমিই হ্রী এবং তুমি নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি। লজ্জা, পুষ্টি, তুষ্টি, শান্তি ও ক্ষমাও তুমিই। তুমি খড়্গধারিণী, শূলধারিণী, ঘোররূপা, তথা গদা, চক্র, শঙ্খ ও ধুনর্ধারিণী। বাণ, ভুশুণ্ডী ও পরিঘা - এসবও তোমার অস্ত্র। তুমি সৌম্যা ও সৌম্যতরা - শুধু তাই নয়, যত কিছু সৌম্য এবং সুন্দর পদার্থ আছে, সেই সবের থেকেও তুমি অত্যধিক সুন্দরী, পর ও অপর - সবের উপরে পরমেশ্বরী তুমিই। হে বিশ্বরূপিণী, যে-কোনও স্থানে যাহা কিছু চেতন বা জড় বস্তু অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতে হইবে সেই সকলের যে শক্তি, তাহা তুমিই। সুতরাং কিরূপে তোমার স্তব করিব? (বিশ্বপ্রপঞ্চে তুমি ভিন্ন যখন আর কিছুই নাই, তখন তোমার স্তব কিরূপে সম্ভব?)। যেই ভগবান এই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও পালন করেন, সেই ভগবানকেও যখন তুমি নিদ্রাবিষ্ট করে রেখেছ, তখন কে তোমার স্তব করতে সমর্থ? আমাকে, ভগবান বিষ্ণুকে ও ভগবান রুদ্রকেও তুমিই শরীর গ্রহণ করিয়েছ; কাজেই তোমার স্তুতি করার মত শক্তি কার আছে? হে দেবি! তুমি তো নিজের এই উদর প্রভাবের দ্বারাই প্রশংসিত। এই যে দুই দুর্জয় অসুর মধু ও কৈটভ এদের তুমি মোহগ্রস্ত করে দাও এবং জগদীশ্বর ভগবান বিষ্ণুকে শীগগিরই জাগরিত করে দাও। সঙ্গে সঙ্গে এই মহাসুরকে বধ করবার জন্য তাঁর প্রবৃত্তি উৎপাদন কর ।।৭৩-৮৭।।
মেধা ঋষি বললেন - ।।৮৮।।
ব্রহ্মা যখন মধু আর কৈটভকে বধ করবার উদ্দেশ্যে ভগবান বিষ্ণুকে যোগনিদ্রা থেকে জাগাবার জন্য তমোগুণের অধিষ্ঠাত্রী দেবী যোগনিদ্রার এই রকম স্তুতি করলেন, তখন সেই দেবী যোগনিদ্রা ভগবান বিষ্ণুর চোখ, মুখ, নাক, বাহু, হৃদয় এবং বক্ষঃস্থল থেকে নিগত হয়ে অব্যক্ত জন্মা ব্রহ্মার দৃষ্টিগোচর হলেন। যোগনিদ্রা ভেঙ্গে যাওয়ার পর জগন্নাথ ভগবান জনার্দন একীভূত মহাসমুদ্রে অবস্থিত অনন্তশয়ান থেকে জেগে উঠলেন। গাত্রোত্থান করে তিনি ওই দুই অসুরকে দেখলেন। তারা, সেই দুরাত্মা, অতি বলবান ও মহাবিক্রমশালী ক্রোধে আরক্ত নয়নে ব্রহ্মাকে ভক্ষণের উদ্যোগ করছিল। অতঃপর ভগবান শ্রীহরি শয্যা ছেড়ে উঠে ওই দুই অসুরের সাথে পাঁচ হাজার বছর ধরে বাহুযুদ্ধ করলেন, ওরা দুজনও অত্যন্ত বলদর্পিত হয়েছিল। এদিকে দেবী মহামায়াও তাদের বিমোহিত করে রেখেছিলেন; ফলে তারা ভগবান বিষ্ণুকে বলল - 'আমরা তোমার বীরত্বে সন্তুষ্ট হয়েছি, তুমি আমাদের কাছে বর প্রার্থনা কর। ' ।।৮৯-৯৫।।
শ্রীভগবান বললেন - ।।৯৬।।
তোমরা দুজনে যদি আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে থাক, তবে তোমরা আমার হাতে বধ্য হও। ব্যস্, এইই আমার একান্ত অভিপ্রায়। অন্য বরের আর কি প্রয়োজন? ।।৯৭-৯৮।।
মেধা ঋষি বললেন - ।।৯৯।।
এইভাবে প্রবঞ্চিত হয়ে যখন তারা সমস্ত জগৎ জলমগ্ন দেখলো, তখন কমলনয়ন ভগবানকে বলল - পৃথিবীর যে জায়গাটা জলমগ্ন হয়নি যেখানে শুকনো জায়গা আছে, সেইস্থানে আমাদের বধ কর ।।১০০-১০১।।
মেধা ঋষি বললেন - ।।১০২।।
শঙ্খ, চক্র ও গদাধারী ভগবান বিষ্ণু 'তাই হোক' বলে ওদের দুজনের মাথা দুটি নিজের ঊরুর ওপর রেখে চক্র দিয়ে ছেদন করলেন। এইভাবে এই দেবী মহামায়া ব্রহ্মা কর্তৃক সংস্তুতা হয়ে স্বয়ং আবির্ভূতা হয়েছিলেন। আমি আবার তোমাদের কাছে এই দেবীর মহিমা বা আবির্ভাবের বিষয় বর্ণনা করছি, শোন ।।১০০-১০৪।।
শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণে সাবর্ণিকমন্বন্তরে দেবীমাহাত্ম্য প্রসঙ্গে মধুকৈটভবধনামক প্রথম অধ্যায় সম্পূর্ণ হল ।। ১ ।।
Friday, 10 February 2017
Durga Astottarasatanaam শ্রীশ্রীদুর্গাষ্টোত্তরশতনাম
দুর্গা ও নন্দী সংবাদ
নমোনমঃ চণ্ডীদেবী মঙ্গলদায়িনী ।
জয় জয় মহামায়া ত্রিদিব-জননী ।।
আমি অতি হীনমতি না জানি পূজন ।
দয়া ক'রি দিও মাগো ও রাঙ্গা চরণ ।।
ত্রিলোকতারিণী তারা অগতির গতি ।
শ্রীচরণে স্থান দিও ওমা ভগবতী ।।
জয় মা কৈলাসেশ্বরী শিবের শিবানী ।
দীনহীন ডাকে তোমা ওগো নিস্তারিণী ।।
নিজগুণে কর দয়া ওমা হররাণি ।
মহেশ্বরী সর্ব্বপাপতাপ নিবারিণী ।।
পাপবিনাশিনী দুর্গে জগতবন্দিনী ।
সুফলদায়িকা যশঃ দেহি মে ভবানী ।।
বিপদে কর মা ত্রাণ সঙ্কটহারিনী ।
জগত জননী মাগো নরকবারিণী ।।
হরপাশে বসি গৌরী কৈলাসশিখরে ।
নানারূপ কন কথা হরিষ অন্তরে ।।
হেনকালে নন্দী আসি দোঁহার সাক্ষাতে ।
প্রণমিল উভয়েরে ভক্তিপূর্ণ চিতে ।।
দয়াময়ী দুর্গা নামে কলঙ্ক শ্রবণে ।
দাঁড়াইল সেই স্থানে বিষাদিত মনে ।।
নন্দীরে হেরিয়া দেবী বিরস বদন ।
হাসিমুখে সুধালেন তাহারে তখন ।।
ঘটিয়াছে কিবা বাছা কহ মোর পাশ ।
কি হেতু হয়েছ তুমি এরূপ হতাশ ।।
দেবী বাক্য শুনি কহে শ্রীনন্দীকেশর ।
দহিতেছে মাগো বড় এ পোড়া অন্তর ।।
ছদ্মবেশে করি যবে পৃথিবী ভ্রমণ ।
পাষাণী কহিল তোমায় যত নরগণ ।।
মর্ত্ত্যবাসী সবে যত বলে পরস্পরে ।
দুঃখহরা নাম সবে ভুল অতঃপরে ।।
কে বলে করেন দুর্গা দুর্গতি নাশন ।
দুর্গানামে ফলে এবে দারিদ্র্য পীড়ন ।।
পাষাণী নামেতে মাগো বড় ব্যথা পাই ।
দহিছে অন্তর মোর ভেবে শুধু তাই ।।
জীবের দুর্গতি হেরি এনু তব পাশ ।
কর দয়া জীবগণে ক'রনা নৈরাশ ।।
দয়াময়ী মা তোমায় বলে সর্ব্বজন ।
কর ত্রাণ নরগণে দিয়ে শ্রীচরণ ।।
জীবের দুর্গতি হেরি পেয়েছি বেদন ।
কর মা জীবের তুমি দুর্গতি মোচন ।।
নাই কারো অন্নবস্ত্র ক'রিছে রোদন ।
হা অন্ন হা অন্ন বলি কাঁপায়ে ভুবন ।।
বড় ব্যথা পায় মাগো মর্ত্তবাসিগণে ।
নাশহ তাদের দুঃখ ভিক্ষা শ্রীচরণে ।।
শুনিয়া নন্দীর বাক্য কহেন শঙ্করী ।
নরগণ পায় দুঃখ দেবতা পাশরি ।।
অনাচারে পূর্ণ এবে হ'য়েছে ধরণী ।
নিজ দোষে পায় দুঃখ আপনা আপনি ।।
প্রভাতে উঠিয়া তারা দেবতা না স্মরে ।
ধরাখানা সরা দেখে অহঙ্কার ভরে ।।
যা হোক্ তা হোক্ বাছা কহি তব পাশ ।
যাহাতে জীবের হবে দুর্গতি বিনাশ ।।
অষ্টোত্তর শতনাম করিলে পঠন ।
আমার নামেতে হবে দুর্গতি মোচন ।।
ছদ্মবেশে যাও বাছা অবনী-মাঝার ।
মম নাম আছে যত করগে প্রচার ।।
মম নাম বাছা তুমি দাও জনে জনে ।
নাম যেন লয় তারা ভক্তিপূর্ণ মনে ।।
'মা', 'মা' বলি আমারে যে ডাকে ভক্তিভরে ।
সদা বাঁধা থাকি বৎস আমি তার ঘরে ।।
শ্রীনন্দীকেশর কহে দেবী বাক্য শুনি ।
শ্রীমুখেতে তব নাম বল গো জননী ।।
করহ বর্ণনা নাম মাগো নিজ মুখে ।
প্রচারিব মর্ত্ত্যলোকে আমি মন সুখে ।।
অসংখ্য আমার নাম শুন বাছাধন ।
অষ্টোত্তর শতনাম কহিব এখন ।।
শ্রীদুর্গার নাম যে বা করিবে পঠন ।
অবশ্য হইবে তার দুর্গতি মোচন ।।
শুন বাছা যে গৃহেতে থাকে মোর নাম ।
মম বরে হয় তার পূর্ণ মনস্কাম ।।
নাম আরম্ভ
জয় দুর্গা (১) দুঃখহরা (২) কৃতান্তদলনী (৩) ।
মহামায়া (৪) কালজায়া (৫) মাগো কাত্যায়নী (৬) ।।
জগত-জননী উমা (৭) ভবেশঘরণী (৮) ।
কর দয়া দয়াময়ী ত্রিদিব জননী (৯) ।।
কালরাত্রি করালিনী (১০) কপালমালিকে (১১) ।
কাতরে করুণা কর জয় মা কালিকে (১২) ।।
কীর্ত্তিবাসপ্রিয়া (১৩) মহারাত্রি মহোদরী (১৪) ।
মহারাণী সুরেশ্বরী (১৫) নমো মা শঙ্করী (১৬) ।।
ব্রহ্মাণ্ড জননী (১৭) তুমি শিবের শিবানী (১৮) ।
প্রণমামি পদে তব সত্যসনাতনী (১৯) ।।
কাতর দেখিয়া কৃপা কর মা ভবানী (২০) ।
অন্নপূর্ণা (২১) মহেশ্বরী (২২) জগততারিণী (২৩) ।।
সর্ব্বসুখদাত্রী মাগো তুমি ভগবতী (২৪) ।
কৃপা কর মহেশ্বরী (২৫) অগতির গতি ।।
নমস্তে সর্ব্বাণী (২৬) মাগো ঈশানী (২৭) ইন্দ্রাণী (২৮) ।
ঈশ্বরী (২৯) ঈশ্বর জায়া গণেশজননী (৩০) ।।
উগ্রচণ্ডা (৩১) উমা অপরাজিতা (৩২) উর্ব্বশী (৩৩) ।
জয় মা রাজরাজেশ্বরী (৩৪) শিবে ষোড়শী (৩৫) ।।
মাতঙ্গী (৩৬) বগলে (৩৭) কল্যাণী কমলে (৩৮) গায়ত্রী (৩৯) ভুবনেশ্বরী (৪০) ।
সর্ব্ববিশ্বোদরী (৪১) শুভে শুভঙ্করী (৪২) ক্ষান্তি ক্ষেম ক্ষেমঙ্করী (৪৩) ।।
সহস্র স্বহস্তে ভীমে ছিন্নমস্তে (৪৪) মাতা মহিষমর্দ্দিনী (৪৫) ।
নিস্তার-কারিণী নরকবারিণা নিশুম্ভ-শুম্ভঘাতিনী ।।
দৈত্য-বিনাশিনী শিব-সীমন্তিনী শৈলসুতে সুবদনী (৪৬) ।
বিরিঞ্চি-নন্দিনী (৪৭) পাপবিনাশিনী দিগম্বরের ঘরণী (৪৮) ।।
দেবী দিগম্বরী (৪৯) দুর্গে দুর্গে অরি কালিকে করাল কেশী ।
শিবে (৫০) শবারূঢ়া চণ্ডী (৫১) চন্দ্রচূড়া ঘোররূপা এলোকেশী (৫২) ।।
শারদা (৫৩) বরদা (৫৪) শুভদা সুখদা অন্নদা (৫৫) কালিকে শ্যামা (৫৬) ।
মৃগেশবাহিনী (৫৭) মহেশ ভাবিনী (৫৮) সুরেশ বন্দিনী বামা ।।
কামাক্ষা রুদ্রাণী (৫৯) হরা হররাণী (৬০) মনোহরা কাত্যায়নী ।
শমনত্রাসিনী (৬১) অরিষ্টনাশিনী (৬২) দয়াময়ী দাক্ষায়ণী (৬৩) ।।
হের মা পার্ব্বতী (৬৪) ওমা ভগবতী আমি দীনহীন অতি ।
কর মোরে দয়া ওগো মহামায়া জানি মোরে মূঢ়মতি ।।
নমস্তে শঙ্করী শঙ্কর সুন্দরী (৬৫) শিবা শাকম্ভরী (৬৬) শ্যামা ।
শিব-সহচরী (৬৭) মায়া মহোদরী (৬৮) মহেশ্বরী হররমা (৬৯) ।।
ত্রিতাপহারিণী (৭০) ত্রিগুণা-তারিণী গুণময়ী গুণাত্মিকে ।
কৌষিকী কমলা করালী বিমলা (৭১) অভয়া (৭২) অম্বে অম্বিকে ।।
ভবে ভবরাণী (৭৩) তরণী ভবানী ভাবিনী ভব-মনোহরা (৭৪) ।
ব্রহ্মাণী (৭৫) রুদ্রাণী কৌমারী সর্ব্বাণী ভয়ঙ্করী শিবকরা ।।
শিব-নিতম্বিনী (৭৬) অরিষ্ট স্তম্ভিনী (৭৭) সুরাসুর নরধাত্রী (৭৮) ।
অপর্ণা (৭৯) অন্নদা (৮০) সর্ব্বাণী সারদা শিবে সর্ব্বসিদ্ধিদাত্রী (৮১) ।।
চামুণ্ডে (৮২) চণ্ডিকে নৃমুণ্ডমালিকে (৮৩) নারায়ণী (৮৪) শিবদারা (৮৫) ।
শাস্তি কান্তিকরী (৮৬) ক্ষমা ক্ষেমঙ্করী ত্রিলোকতারিণী তারা (৮৭) ।।
মহা মহেশ্বরী প্রিয়ে প্রিয়ঙ্করী (৮৮) শুভঙ্করী কপালিনী (৮৯) ।
জগতজননী মৃগাঙ্ক-আননী (৯০) ভীমে (৯১) নৃমুণ্ডমালিনী (৯২) ।।
গিরীন্দ্র নন্দিনী (৯৩) গিরীশ বন্দিনী (৯৪) গোমাতা গৌরী (৯৫) গান্ধারী ।
গো-গজ জননী (৯৬) গজেন্দ্রগামিনী গীতা গোপেশকুমারী (৯৭) ।।
গোবিন্দ ভগিনী (৯৮) যোগেশ যোগিনী (৯৯) দৈবকী গর্ভস্রাবিণী ।
পরা-পরায়ণী (১০০) দেবী দাক্ষায়ণী দক্ষযজ্ঞ বিনাশিনী (১০১) ।।
চন্দ্রে চন্দ্রচূড়া হরসিংহারূঢ়া (১০২) মতি মেনকা দুলালী (১০৩) ।
শ্রাস্তে চণ্ডিকা অশিব খণ্ডিকা ভদ্রকালী (১০৪) মহাকালী (১০৫) ।।
দানব কৃন্তিনী বৈষ্ণবী জম্ভিনী (১০৬) ভৈরবী বিজয়া জয়া (১০৭) ।
বল প্রমথিনী মন্মথমথিনী (১০৮) মহিষঘাতিনী দয়া ।।
নমস্তে কালিকে কালভয়নিবারিণী ।
জয় জয় সর্ব্বভূতে কল্যাণকারিণী ।।
নমঃ কালী কালাকালে কালনিবারিণী ।
মহাকাল মনোহরা মহেশ-মোহিনী ।।
ত্রিলোচনা উমা ধূমা বিকলা বিমলা ।
মুণ্ডমালা বিভূষণা ভৈরবী বগলা ।।
দৈত্যবিনাশিনী মাতা মহিষমর্দ্দিনী ।
মহামায়া মহেশ্বরী করুণাদায়িনী ।।
কালরাত্রি করালিনী স্মরহর-প্রিয়ে ।
রাখ মা চরণতলে কৃপা বিতরিয়ে ।।
ত্বমেব শারদাশিবা শঙ্করী কমলা ।
ত্বমেকা প্রকৃতি পরা মহিমা অচলা ।।
বিশ্বকর্ত্রী শৈলপুত্রী স্কন্দমাত্রী ভীমা ।
গায়ত্রী অনন্তশক্তি অনন্ত অসীমা ।।
জগতে দায়িনী জয় জগদম্বা তারা ।
যোগেশী যোগিনী জয়া যোগেশ্বর দারা ।।
শত্রুজয়ী হয় তারা যে তোমারে স্মরে ।
বিষম বিপদ হ'তে অনায়াসে তরে ।।
দুর্গানামে দুঃখ হরে দিগম্বর কয় ।
জনম মরণ নাশে যায় যমভয় ।।
বিপদে যে দুর্গানাম বলে একবার ।
নিশ্চয় চলিয়ে যায় বিপদ্ তাহার ।।
দুর্গা বলি যেই জন ডাকে মনে প্রাণে ।
সম্পদ্ বর্দ্ধিত হয় নামের স্মরণে ।।
কর দয়া মহামায়া ওমা শিবরাণী ।
যোড় করে যাচে ইন্দু চরণ দু'খানি ।।
ইতি শ্রীশ্রীদুর্গার অষ্টোত্তর শতনাম সমাপ্ত
নমোনমঃ চণ্ডীদেবী মঙ্গলদায়িনী ।
জয় জয় মহামায়া ত্রিদিব-জননী ।।
আমি অতি হীনমতি না জানি পূজন ।
দয়া ক'রি দিও মাগো ও রাঙ্গা চরণ ।।
ত্রিলোকতারিণী তারা অগতির গতি ।
শ্রীচরণে স্থান দিও ওমা ভগবতী ।।
জয় মা কৈলাসেশ্বরী শিবের শিবানী ।
দীনহীন ডাকে তোমা ওগো নিস্তারিণী ।।
নিজগুণে কর দয়া ওমা হররাণি ।
মহেশ্বরী সর্ব্বপাপতাপ নিবারিণী ।।
পাপবিনাশিনী দুর্গে জগতবন্দিনী ।
সুফলদায়িকা যশঃ দেহি মে ভবানী ।।
বিপদে কর মা ত্রাণ সঙ্কটহারিনী ।
জগত জননী মাগো নরকবারিণী ।।
হরপাশে বসি গৌরী কৈলাসশিখরে ।
নানারূপ কন কথা হরিষ অন্তরে ।।
হেনকালে নন্দী আসি দোঁহার সাক্ষাতে ।
প্রণমিল উভয়েরে ভক্তিপূর্ণ চিতে ।।
দয়াময়ী দুর্গা নামে কলঙ্ক শ্রবণে ।
দাঁড়াইল সেই স্থানে বিষাদিত মনে ।।
নন্দীরে হেরিয়া দেবী বিরস বদন ।
হাসিমুখে সুধালেন তাহারে তখন ।।
ঘটিয়াছে কিবা বাছা কহ মোর পাশ ।
কি হেতু হয়েছ তুমি এরূপ হতাশ ।।
দেবী বাক্য শুনি কহে শ্রীনন্দীকেশর ।
দহিতেছে মাগো বড় এ পোড়া অন্তর ।।
ছদ্মবেশে করি যবে পৃথিবী ভ্রমণ ।
পাষাণী কহিল তোমায় যত নরগণ ।।
মর্ত্ত্যবাসী সবে যত বলে পরস্পরে ।
দুঃখহরা নাম সবে ভুল অতঃপরে ।।
কে বলে করেন দুর্গা দুর্গতি নাশন ।
দুর্গানামে ফলে এবে দারিদ্র্য পীড়ন ।।
পাষাণী নামেতে মাগো বড় ব্যথা পাই ।
দহিছে অন্তর মোর ভেবে শুধু তাই ।।
জীবের দুর্গতি হেরি এনু তব পাশ ।
কর দয়া জীবগণে ক'রনা নৈরাশ ।।
দয়াময়ী মা তোমায় বলে সর্ব্বজন ।
কর ত্রাণ নরগণে দিয়ে শ্রীচরণ ।।
জীবের দুর্গতি হেরি পেয়েছি বেদন ।
কর মা জীবের তুমি দুর্গতি মোচন ।।
নাই কারো অন্নবস্ত্র ক'রিছে রোদন ।
হা অন্ন হা অন্ন বলি কাঁপায়ে ভুবন ।।
বড় ব্যথা পায় মাগো মর্ত্তবাসিগণে ।
নাশহ তাদের দুঃখ ভিক্ষা শ্রীচরণে ।।
শুনিয়া নন্দীর বাক্য কহেন শঙ্করী ।
নরগণ পায় দুঃখ দেবতা পাশরি ।।
অনাচারে পূর্ণ এবে হ'য়েছে ধরণী ।
নিজ দোষে পায় দুঃখ আপনা আপনি ।।
প্রভাতে উঠিয়া তারা দেবতা না স্মরে ।
ধরাখানা সরা দেখে অহঙ্কার ভরে ।।
যা হোক্ তা হোক্ বাছা কহি তব পাশ ।
যাহাতে জীবের হবে দুর্গতি বিনাশ ।।
অষ্টোত্তর শতনাম করিলে পঠন ।
আমার নামেতে হবে দুর্গতি মোচন ।।
ছদ্মবেশে যাও বাছা অবনী-মাঝার ।
মম নাম আছে যত করগে প্রচার ।।
মম নাম বাছা তুমি দাও জনে জনে ।
নাম যেন লয় তারা ভক্তিপূর্ণ মনে ।।
'মা', 'মা' বলি আমারে যে ডাকে ভক্তিভরে ।
সদা বাঁধা থাকি বৎস আমি তার ঘরে ।।
শ্রীনন্দীকেশর কহে দেবী বাক্য শুনি ।
শ্রীমুখেতে তব নাম বল গো জননী ।।
করহ বর্ণনা নাম মাগো নিজ মুখে ।
প্রচারিব মর্ত্ত্যলোকে আমি মন সুখে ।।
অসংখ্য আমার নাম শুন বাছাধন ।
অষ্টোত্তর শতনাম কহিব এখন ।।
শ্রীদুর্গার নাম যে বা করিবে পঠন ।
অবশ্য হইবে তার দুর্গতি মোচন ।।
শুন বাছা যে গৃহেতে থাকে মোর নাম ।
মম বরে হয় তার পূর্ণ মনস্কাম ।।
নাম আরম্ভ
জয় দুর্গা (১) দুঃখহরা (২) কৃতান্তদলনী (৩) ।
মহামায়া (৪) কালজায়া (৫) মাগো কাত্যায়নী (৬) ।।
জগত-জননী উমা (৭) ভবেশঘরণী (৮) ।
কর দয়া দয়াময়ী ত্রিদিব জননী (৯) ।।
কালরাত্রি করালিনী (১০) কপালমালিকে (১১) ।
কাতরে করুণা কর জয় মা কালিকে (১২) ।।
কীর্ত্তিবাসপ্রিয়া (১৩) মহারাত্রি মহোদরী (১৪) ।
মহারাণী সুরেশ্বরী (১৫) নমো মা শঙ্করী (১৬) ।।
ব্রহ্মাণ্ড জননী (১৭) তুমি শিবের শিবানী (১৮) ।
প্রণমামি পদে তব সত্যসনাতনী (১৯) ।।
কাতর দেখিয়া কৃপা কর মা ভবানী (২০) ।
অন্নপূর্ণা (২১) মহেশ্বরী (২২) জগততারিণী (২৩) ।।
সর্ব্বসুখদাত্রী মাগো তুমি ভগবতী (২৪) ।
কৃপা কর মহেশ্বরী (২৫) অগতির গতি ।।
নমস্তে সর্ব্বাণী (২৬) মাগো ঈশানী (২৭) ইন্দ্রাণী (২৮) ।
ঈশ্বরী (২৯) ঈশ্বর জায়া গণেশজননী (৩০) ।।
উগ্রচণ্ডা (৩১) উমা অপরাজিতা (৩২) উর্ব্বশী (৩৩) ।
জয় মা রাজরাজেশ্বরী (৩৪) শিবে ষোড়শী (৩৫) ।।
মাতঙ্গী (৩৬) বগলে (৩৭) কল্যাণী কমলে (৩৮) গায়ত্রী (৩৯) ভুবনেশ্বরী (৪০) ।
সর্ব্ববিশ্বোদরী (৪১) শুভে শুভঙ্করী (৪২) ক্ষান্তি ক্ষেম ক্ষেমঙ্করী (৪৩) ।।
সহস্র স্বহস্তে ভীমে ছিন্নমস্তে (৪৪) মাতা মহিষমর্দ্দিনী (৪৫) ।
নিস্তার-কারিণী নরকবারিণা নিশুম্ভ-শুম্ভঘাতিনী ।।
দৈত্য-বিনাশিনী শিব-সীমন্তিনী শৈলসুতে সুবদনী (৪৬) ।
বিরিঞ্চি-নন্দিনী (৪৭) পাপবিনাশিনী দিগম্বরের ঘরণী (৪৮) ।।
দেবী দিগম্বরী (৪৯) দুর্গে দুর্গে অরি কালিকে করাল কেশী ।
শিবে (৫০) শবারূঢ়া চণ্ডী (৫১) চন্দ্রচূড়া ঘোররূপা এলোকেশী (৫২) ।।
শারদা (৫৩) বরদা (৫৪) শুভদা সুখদা অন্নদা (৫৫) কালিকে শ্যামা (৫৬) ।
মৃগেশবাহিনী (৫৭) মহেশ ভাবিনী (৫৮) সুরেশ বন্দিনী বামা ।।
কামাক্ষা রুদ্রাণী (৫৯) হরা হররাণী (৬০) মনোহরা কাত্যায়নী ।
শমনত্রাসিনী (৬১) অরিষ্টনাশিনী (৬২) দয়াময়ী দাক্ষায়ণী (৬৩) ।।
হের মা পার্ব্বতী (৬৪) ওমা ভগবতী আমি দীনহীন অতি ।
কর মোরে দয়া ওগো মহামায়া জানি মোরে মূঢ়মতি ।।
নমস্তে শঙ্করী শঙ্কর সুন্দরী (৬৫) শিবা শাকম্ভরী (৬৬) শ্যামা ।
শিব-সহচরী (৬৭) মায়া মহোদরী (৬৮) মহেশ্বরী হররমা (৬৯) ।।
ত্রিতাপহারিণী (৭০) ত্রিগুণা-তারিণী গুণময়ী গুণাত্মিকে ।
কৌষিকী কমলা করালী বিমলা (৭১) অভয়া (৭২) অম্বে অম্বিকে ।।
ভবে ভবরাণী (৭৩) তরণী ভবানী ভাবিনী ভব-মনোহরা (৭৪) ।
ব্রহ্মাণী (৭৫) রুদ্রাণী কৌমারী সর্ব্বাণী ভয়ঙ্করী শিবকরা ।।
শিব-নিতম্বিনী (৭৬) অরিষ্ট স্তম্ভিনী (৭৭) সুরাসুর নরধাত্রী (৭৮) ।
অপর্ণা (৭৯) অন্নদা (৮০) সর্ব্বাণী সারদা শিবে সর্ব্বসিদ্ধিদাত্রী (৮১) ।।
চামুণ্ডে (৮২) চণ্ডিকে নৃমুণ্ডমালিকে (৮৩) নারায়ণী (৮৪) শিবদারা (৮৫) ।
শাস্তি কান্তিকরী (৮৬) ক্ষমা ক্ষেমঙ্করী ত্রিলোকতারিণী তারা (৮৭) ।।
মহা মহেশ্বরী প্রিয়ে প্রিয়ঙ্করী (৮৮) শুভঙ্করী কপালিনী (৮৯) ।
জগতজননী মৃগাঙ্ক-আননী (৯০) ভীমে (৯১) নৃমুণ্ডমালিনী (৯২) ।।
গিরীন্দ্র নন্দিনী (৯৩) গিরীশ বন্দিনী (৯৪) গোমাতা গৌরী (৯৫) গান্ধারী ।
গো-গজ জননী (৯৬) গজেন্দ্রগামিনী গীতা গোপেশকুমারী (৯৭) ।।
গোবিন্দ ভগিনী (৯৮) যোগেশ যোগিনী (৯৯) দৈবকী গর্ভস্রাবিণী ।
পরা-পরায়ণী (১০০) দেবী দাক্ষায়ণী দক্ষযজ্ঞ বিনাশিনী (১০১) ।।
চন্দ্রে চন্দ্রচূড়া হরসিংহারূঢ়া (১০২) মতি মেনকা দুলালী (১০৩) ।
শ্রাস্তে চণ্ডিকা অশিব খণ্ডিকা ভদ্রকালী (১০৪) মহাকালী (১০৫) ।।
দানব কৃন্তিনী বৈষ্ণবী জম্ভিনী (১০৬) ভৈরবী বিজয়া জয়া (১০৭) ।
বল প্রমথিনী মন্মথমথিনী (১০৮) মহিষঘাতিনী দয়া ।।
নমস্তে কালিকে কালভয়নিবারিণী ।
জয় জয় সর্ব্বভূতে কল্যাণকারিণী ।।
নমঃ কালী কালাকালে কালনিবারিণী ।
মহাকাল মনোহরা মহেশ-মোহিনী ।।
ত্রিলোচনা উমা ধূমা বিকলা বিমলা ।
মুণ্ডমালা বিভূষণা ভৈরবী বগলা ।।
দৈত্যবিনাশিনী মাতা মহিষমর্দ্দিনী ।
মহামায়া মহেশ্বরী করুণাদায়িনী ।।
কালরাত্রি করালিনী স্মরহর-প্রিয়ে ।
রাখ মা চরণতলে কৃপা বিতরিয়ে ।।
ত্বমেব শারদাশিবা শঙ্করী কমলা ।
ত্বমেকা প্রকৃতি পরা মহিমা অচলা ।।
বিশ্বকর্ত্রী শৈলপুত্রী স্কন্দমাত্রী ভীমা ।
গায়ত্রী অনন্তশক্তি অনন্ত অসীমা ।।
জগতে দায়িনী জয় জগদম্বা তারা ।
যোগেশী যোগিনী জয়া যোগেশ্বর দারা ।।
শত্রুজয়ী হয় তারা যে তোমারে স্মরে ।
বিষম বিপদ হ'তে অনায়াসে তরে ।।
দুর্গানামে দুঃখ হরে দিগম্বর কয় ।
জনম মরণ নাশে যায় যমভয় ।।
বিপদে যে দুর্গানাম বলে একবার ।
নিশ্চয় চলিয়ে যায় বিপদ্ তাহার ।।
দুর্গা বলি যেই জন ডাকে মনে প্রাণে ।
সম্পদ্ বর্দ্ধিত হয় নামের স্মরণে ।।
কর দয়া মহামায়া ওমা শিবরাণী ।
যোড় করে যাচে ইন্দু চরণ দু'খানি ।।
ইতি শ্রীশ্রীদুর্গার অষ্টোত্তর শতনাম সমাপ্ত
Thursday, 9 February 2017
Devi Bhagwat : Devi Bhagwat in Bengali, Devi Bhagwat Mahatya Chapter 2 দেবী ভাগবত পুরাণ
দেবী ভাগবত পুরাণ
শ্রীমদ্দেবীভাগবত-মাহাত্য
দ্বীতিয়োধ্যায়
দেবীভাগবত মাহাত্য-প্রসঙ্গে জাম্ববানের নিকট হতে শ্রীকৃষ্ণের মণি প্রাপ্তি তথা জাম্ববতী সহিত বিবাহ করে দ্বারকায় পুনঃ আগমনের কথা
ঋষিগণ প্রশ্ন করিলেন -
হে মহাবুদ্ধিমান সূত! মহাভাগ বসুদেব কেমন করে পুত্রকে প্রাপ্ত করলেন? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পরিভ্রমণ করে প্রসেনকে কোথায় খুঁজেছিলেন এবং কি কারণে খুঁজেছিলেন? ।।১।।
শ্রীমদ্দেবীভাগবতের এই কথা বসুদেব কোন বিধির দ্বারা শ্রবণ করেছিলেন এবং এর বক্তা কে হয়েছিলেন? এসব বর্ণনা করার কৃপা করুন ।।২।।
ঋষি সূত কহিলেন -
ভোজবংশী রাজা সত্রাজিত দ্বারকায় সুখপূর্বক নিবাস করতেন। তিনি সদা সূর্যদেবের আরাধনা করতেন ।।৩।।
ভগবান সূর্যদেব সত্রাজিতের ভক্তিতে পরম প্রসন্ন হয়ে তাকে নিজ লোকের দর্শন করালেন ।।৪।।
তিনি তাকে 'স্যমন্তক' নামক মণি প্রদান করলেন। সত্রাজিত সেই মণি গলে ধারণ করে দ্বারকায় আসিলেন ।।৫।।
সেই মণি ছিল অত্যন্ত ভাস্বরযুক্ত। তাকে দর্শণ করে পুরবাসিরা ভাবিলেন ইনি সূর্যনারায়ণ। অতঃএব সভায় তিষ্ঠ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিকট গমন করে তাকে কহিলেন - 'হে জগতপ্রভু ! সূর্যনারায়ণ দেব পদার্পণ করিছেন'। তাদের কথা শ্রবণ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখমণ্ডল হাস্যে পরিণত হল ।।৬-৭।।
তিনি কহিলেন - 'হে বালকগণ! ইনি সূর্যনারায়ণ নয়। স্যমন্তকমণি ধারণ করে সত্রাজিত পদার্পণ করিছেন। এই মণির কারণেই তার এমন জ্যোতি। দেব সূর্যনারায়ণ তাহাকে এই মণি প্রদাণ করেছেন ।।৮।।
তদনন্তর বিপ্রগণকে ডেকে সত্রাজিত তাদের দ্বারা স্বস্তি-যাচন করালেন, মণির পূজা করিলেন এবং সেই মণিকে নিজ ভবনে স্থাপিত করিলেন ।।৯।।
প্রতিদিন আঠ ভার সুবর্ণ প্রদানকারী এই মণি যেই স্থানেই অবস্থিত থাকিত, সেথায় মহামারী, দুর্ভিক্ষ এবং অন্য উৎপাতসম্বন্ধী ভয় কদাপি থাকিত না ।।১০।।
সত্রাজিতের প্রসেন নামক এক ভ্রাতা ছিল। এক বার তিনি সেই মণিকে গলে ধারণ করে অশ্বোপরি তিষ্ঠ হয়ে শিকার করিতে বনে গমন করলেন। তাকে সিংহ দর্শণ করতেই অশ্বসহিত হত্যা করে মণি অধিকার করিল ।।১১-১২।।
ঋক্ষরাজ জাম্ববান সেথায় গমন করেছিলেন। তিনি দেখলেন, সিংহ মণি অধিকার করেছেন। অতঃএব বিলের দ্বারেই সিংহকে বধ করে তিনি সেই মণি অধিকার করলেন ।।১৩।।
তিনি সেটিকে নিজ পুত্রকে ক্রীড়ার্থে প্রদান করিলেন। তার পুত্র সেই ভাস্বরযুক্ত মণি গ্রহণ করে ক্রীড়া করিতে লাগিল ।।১৪।।
কিছু কালান্তরের পশ্চাৎও যখন প্রসেনের পুনঃআগমন ঘটিল না তখন সত্রাজিতের মহান দুঃখ হল। তিনি কহিলেন - 'কে জানে কার মণি প্রাপ্ত করার ইচ্ছা হল, কার হাথে প্রসেন কালের গ্রাস হয়ে গেল!' ।।১৫।।
এরপর জনসমাজের মুখে দ্বারকায় এই প্রকারের নিন্দা কথিত হল যে মণির প্রতি আসক্তির কারণে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রসেনকে বধ করেছে ।।১৬।।
এই কথা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রবণ করিলেন। তখন নিজের উপর এই মিথ্যা কলঙ্ককে দূর করিতে তিনি কিছু পুরবাসি সহিত যাত্রা প্রারম্ভ করিলেন ।।১৭।।
তিনি বনে গমন করিলেন। সেথায় সিংহদ্বারা হত প্রসেনকে দেখিলেন। রক্তদ্বারা চিহ্নিত মার্গে সিংহকে খুজতে তিনি অগ্রসর হলেন ।।১৮।।
একটি বিলের দ্বারে মৃত সিংহকে দেখিলেন। তখন তিনি পুরবাসিদের কৃপাবশত কহিলেন - 'তোমরা আমার পুনঃআগমন না হওয়া পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা কর। মণি হরণকারি ব্যক্তিকে খুজিতে আমি বিলে প্রবেশ করছি' ।।১৯-২০।।
যথাআজ্ঞা কহে পুরবাসী সেই স্থানেই তিষ্ট হলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিলের অন্দরে সেই স্থানে গমন করিলেন যেখানে জাম্ববানের নিবাস ছিল ।।২১।।
তিনি ঋক্ষরাজের বালককে মণি হস্তে দেখিলেন। তিনি মণি হরণ করার প্রচেষ্ঠা করিলেন। ইতিমধ্যেই ধাত্রী ভীষণ শব্দে গর্জনা প্রারম্ভ করিল ।।২২।।
ধাত্রির গর্জনা শ্রবণ করে সেই স্থানে শীঘ্রই জাম্ববানের আগমন ঘটিল। তার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সহিত যুদ্ধ প্রারম্ভ হয়ে গেল। অহর্নিশি সেই যুদ্ধ চলিল ।।২৩।।
সপ্তবিংশ দিবস পর্যন্ত তাদের মধ্যে ঘোর সংগ্রাম চলিল। অন্যদিকে দ্বারকাবাসী বিলের দ্বারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতীক্ষায় ছিল ।।২৪।।
দ্বাদশ দিবস তারা প্রতীক্ষা করিল। তৎপশ্চাৎ ভীত হয়ে তারা নিজ-নিজ গৃহে গমন করিল। সেথায় গমন করে তারা প্রারম্ভ হতে অন্ত পর্যন্ত সমস্ত কথা কহিলেন ।।২৫।।
সেই কথা শ্রবণ করে সবারই মহান কষ্ট হল। তারা তখন সত্রাজিতের নিন্দা করিতে লাগিল। নিজ পুত্রের এই কষ্টের কথা মহাভাগ বসুদেবের কর্ণেও প্রবেশ করিল ।।২৬।।
সপরিবার তিনি শোকসাগরে ওঠা-নামা করিতে লাগিলেন। 'এবার আমার কল্যাণ কিপ্রকারে হবে!' এমন অনেক চিন্তাই তার মনে উৎপন্ন হল ।।২৭।।
সেইকালেই ব্রহ্মলোক হতে দেবর্ষি নারদের সেথায় আগমন ঘটিল। বসুদেব উঠিয়া মুনিকে প্রণাম করিলেন। তার যথোচিত পূজা করিলেন ।।২৮।।
নারদমুনি বুদ্ধিমান বসুদেবের কুশল-সংবাদ নিলেন। এরপর তিনি প্রশ্ন করিলেন - 'হে যদুশ্রেষ্ঠ! আপনি কি কারণে চিন্তাগ্রস্থ?' ।।২৯।।
বসুদেব কহিলেন -
আমার প্রিয় পুত্র শ্রীকৃষ্ণ প্রসেনের সন্ধান করিতে পুরবাসিসহিত বনে গমন করেছিল। মৃত প্রসেনের উপর তার দৃষ্টি পরেছিল ।।৩০।।
বিলের দ্বারে প্রসেনের হত্যাকারী সিংহকে মৃত দেখিল। তখন পুরবাসিদের বিলের দ্বারেই অপেক্ষা করিয়ে সে স্বয়ং অন্দরে প্রবেস করিল ।।৩১।।
হে মুনি! বহু দিবস ব্যতীত হয়ে গিয়েছে, এখনও আমার সেই প্রাণপ্রিয় পুত্রের পুনঃআগমন হল না। এতেই আমি চিন্তিত। কৃপা করে এমন কোন উপায় বলুন যার দ্বারা আমার পুত্রের শীঘ্রই পুনঃআগমন ঘটে ।।৩২।।
দেবর্ষি নারদ কহিলেন -
হে যদুশ্রেষ্ঠ! আপনি পুত্রপ্রাপ্তির হেতু অম্বিকা দেবীর আরাধনা করুন। তার আরাধনার দ্বারাই আপনার শীঘ্র কল্যাণ হবে ।।৩৩।।
বসুদেব কহিলেন -
হে দেবর্ষি! সেই অম্বিকা দেবী কে? তার মহিমা কি এবং কি প্রকারে তার পূজা হয়? হে ভগবন! ইহা বলিবার কৃপা করুন ।।৩৪।।
দেবর্ষি নারদ কহিলেন -
হে মহাভাগ বসুদেব! দেবী অম্বিকার মাহাত্য অতুল্য। তার সম্পূর্ণ মাহাত্যকে বিস্তাররূপে কে বলতে পারে! আমি সংক্ষেপে কিছু বলছি তা শ্রবণ করুন ।।৩৫।।
ভগবতী অম্বিকা নিত্যা। তিনি সচ্চিদানন্দরূপিণী। তিনি সর্বোপরি। এই সম্পুর্ণ চরাচর জগতে তিনি ব্যাপ্ত ।।৩৬।।
তার আরাধনার প্রভাবেই জগতপিতা ব্রহ্মা এই চরাচর জগতের সৃজন করেন। মধু এবং কৈটভের দ্বারা ভয়ভীত হয়ে পিতামহ দেবীর স্তুতি করেছিলেন আর তার প্রসাদ রূপে সেই ভয় হতে মুক্ত হয়েছিলেন ।।৩৭।।
তারই কৃপায় ভগবান বিষ্ণু এই জগতের সংরক্ষণ করেন। ভগবান রুদ্র সংসারের সংহারকার্যে সফল তখনই হন যখন দেবী তার কৃপাদৃষ্টি নিরীক্ষণ করেন ।।৩৮।।
তিনিই এই সংসার বন্ধনের কারণ, আবার তিনিই মুক্তিপ্রদায়িনী। সেই দেবী পরম বিদ্যাস্বরূপিণী, তিনি সর্বেশ্বরেরও ঈশ্বরী ।।৩৯।।
আপনি নবরাত্র-বিধিতে সেই ভগবতী জগদম্বিকার পূজা করে নয় দিবসে শ্রীমদ্দেবীভাগবত পুরাণ শ্রবণ করুন ।।৪০।।
সেই পুরাণের শ্রবণ মাত্রই শীঘ্রই আপনার পুত্রের পুনঃআগমন ঘটিবে। যে এই পুরাণের পাঠ এবং শ্রবণ করে তার থেকে ভুক্তি-মুক্তি দূরে থাকিতে পারে না ।।৪১।।
এই কথা বলার পরে শ্রী বসুদেব নারদ মুনিকে মস্তক ঝুকিয়ে চরণে প্রণাম করিলেন এবং অপার প্রসন্নতা প্রকট করে কহিলেন ।।৪২।।
বসুদেব কহিলেন -
হে ভগবান! আপনার বাক্যের দ্বারা আমার ভগবতী জগদম্বিকার কৃপা-প্রসাদের দ্বারা সিদ্ধ নিজের পূর্বপ্রসঙ্গ স্মরন হল। সেই দেবীর মাহাত্য কথা আমি বলছি, আপনি শ্রবণ করুন ।।৪৩।।
পুরাতন কথা, আকাশবাণী দ্বারা জ্ঞাত হয়ে যে 'দেবকীর অষ্টম গর্ভের দ্বারাই কংসের নিধন হবে' সেই পাপী কংস ভয়ের কারণে আমাকে সভায় ঘিরে ধরেছিল ।।৪৪।।
নিজ ভার্যা দেবকীর সহিত আমাকে কারাগারে বাস করিতে হয়েছিল। যত বার আমার পুত্রের জন্ম হত ততবার পাপকর্মে লিপ্ত সেই কংস তাকে বধ করিত ।।৪৫।।
কংসের হস্তে আমার ছয় পুত্র নিহত হওয়ার কারণে দেবকী শোকে আকুল হয়ে গিয়েছেল। সেই দেবী রূপী নারী দিবস-রাত্রি কেবল চিন্তা করিত ।।৪৬।।
তখন আমি গর্গমুনিকে আহবান করে তার চরণে মস্তক নত করে তাকে পূজেছিলাম। তার কাছে দেবকীর দুঃখ কথা নিবেদন করে পুত্র প্রাপ্তির কামনা প্রকট করেছিলাম ।।৪৭।।
আমি বলেছিলাম - "হে ভগবান! আপনি করুণাসিন্ধু। আপনি যদুদের গুরু। হে মুনি! আপনি দীর্ঘজীবী পুত্র প্রাপ্তির সাধন বলিবার কৃপা করুন" ।।৪৮।।
তখন দয়ানিধি গর্গমুনি আমার দ্বারা প্রসন্ন হয়ে কহিলেন - হে মহাভাগ বসুদেব! দীর্ঘজীবী পুত্র প্রাপ্ত করিবার উপায় আমি বলছি, তুমি শ্রবণ কর ।।৪৯।।
সেই ভগবতী দুর্গা ভক্তদুর্গতিহারিণী। তুমি সেই কল্যাণী দেবীর আরাধনা কর। তার আরাধনার দ্বারাই তোমার শ্রেয় হবে ।।৫০।।
তার আরাধনার দ্বারাই সবার সর্বমনোকামনা পূর্ণ হয়। যার ভগবতী দুর্গার উপরে ভক্তি আছে তার কাছে জগতে কিছুই দুর্লভ নেই ।।৫১।।
মুনির এই বচনের পর আমাদের উভয়ের হৃদয়ে অপার হর্ষ হল। আমি অত্যন্ত ভক্তিপূর্বক ওনাকে প্রণাম করিলাম এবং জোরহস্তে কহিলাম ।।৫২।।
বসুদেব কহিলেন -
হে ভগবান! আপনি করুণানিধি। যদি আমার উপরে আপনার প্রীতি থাকে তবে মথুরাপুরীতেই আপনি আমার হেতু চণ্ডিকা দেবীর আরাধনা প্রারম্ভ করে দিন ।।৫৩।।
হে মহামতি! আমি কংসের গৃহে নিরুদ্ধ। আমার উৎসাহ থাকিলেও আমি কেমন করে করিব? অতএব আপনিই এই দুঃখরূপী দুস্তর সাগর হতে উদ্ধার করার কৃপা করুন ।।৫৪।।
এই প্রকার আমার কথার পর মুনিবর আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে কহিলেন - 'বসুদেব! তুমি আমার অতি প্রিয় পাত্র, অতএব তোমার হিত আমি অবশ্যই করিব' ।।৫৫।।
অতএব আমার প্রতি প্রীতির কারণে এবং আমার প্রেমপুর্বক প্রার্থনা করার পর গর্গমুনি দেবী দুর্গার আরাধনা করিবার জন্য ব্রাহ্মণ সহিত বিন্ধ্যপর্বতে গমন করিলেন ।।৫৬।।
সেথায় গমন করে তিনি জপ-পাঠে সংলগ্ন হয়ে ভক্তঅভীষ্টপ্রদায়িনী দেবী জগদ্ধাত্রীর আরাধনা করিতে লাগিলেন ।।৫৭।।
যথাকালে নিয়ম-অনুষ্ঠানের সমাপ্তির পর আকাশবাণী হল - "হে মুনিবর! আমি প্রসন্ন। তোমার কার্যসিদ্ধি অবশ্যই হবে।" ।।৫৮।।
ভুভারহরণার্থে আমি শ্রীহরিকে সংবাদ প্রেরণ করেছি। বসুদেবের নিকটে দেবকীর গর্ভ হতে তিনি তাঁর অংশাবতার গ্রহণ করিবেন ।।৫৯।।
কংসের ভয়ে ভীত হয়ে বসুদেব সেই বালককে প্রাপ্ত করে তাঁকে গোকুলে নন্দের গৃহে পৌছে দেবেন ।।৬০।।
তিনি যশোদার কন্যাকে স্বগৃহে আনিয়া কংসের হস্তে প্রদান করিবেন। কংসের হস্তে প্রদান করা মাত্রই কংস তাঁকে হত্যা করিতে ক্ষিতিতে নিক্ষেপ করিবে ।।৬১।।
তখনই সেই কন্যা তার হস্ত হতে নির্গমন করিবে এবং তাঁর দিব্য রূপ প্রকট হবে। আমারই অংশরূপ ধারণ করে সে বিন্ধ্যগিরিতে গমন করে জগত কল্যাণে সংলগ্ন হবে ।।৬২।।
এই প্রকার দেবীর বচন শ্রবণ করে গর্গমুনি জগদম্বিকাকে প্রণাম করিলেন। অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে তিনি মথুরাপুরীতে আগমন করিলেন ।।৬৩।।
গর্গআচার্যের মুখ হতে আমি মহাদেবীর বরদান শ্রবণ করিলাম। ভার্যাসহিত শ্রবণ করে আমার অত্যন্ত প্রীতি হল। আমার হৃদয়ে আনন্দ সমুদ্রের আগমন হল ।।৬৪।।
সেইকাল হতেই আমার দেবীর উত্তম মাহাত্যের জ্ঞান হয়েছিল। হে দেবর্ষি! এখনও আমি আপনার মুখারবিন্দ হতে সেই মাহাত্যই শ্রবণ করিতেছি ।।৬৫।।
অতএব হে প্রভু! আপনিই আমাকে দেবীভাগবত শোনাবার কৃপা করুন। হে দেবর্ষি! আপনি দয়ানিধি, আমার সৌভাগ্যের কারণেই আপনার এই স্থানে আগমন ঘটেছে ।।৬৬।।
বসুদেবের বচন শ্রবণ করে নারদের মনে প্রীতি হল। সুদিনে এবং শুভনক্ষত্রে তিনি কথা আরম্ভ করিলেন ।।৬৭।।
কথার নির্বিঘ্নে সমাপ্তির জন্য অনেক দ্বিজ নবার্ণ-জপ করিতে লাগিল এবং মার্কণ্ডেয়পুরাণে উক্ত দেবীর স্তব পাঠ করিতে লাগিল ।।৬৮।।
শ্রীনারদ প্রথম স্কন্ধ হতে কথা আরম্ভ করিলেন। বসুদেব ভাগবতামৃত ভক্তিপূর্বক শ্রবণ করিতে লাগিলেন ।।৬৯।।
নবম দিবসে কথার পূর্তি হবার পর মহামনা বসুদেব প্রসন্ন হয়ে পুস্তক এবং কথাবাচকের যথোচিত পূজা করিলেন ।।৭০।।
সেই কালে বিলে জাম্ববান সহিত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের যুদ্ধ চলছিল। কিছুকাল পশ্চাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুষ্টিপ্রহারের দ্বারা জাম্ববান আহত হল, তাঁর দেহ রক্তে জর্জরিত হল ।।৭১।।
স্মৃতি ফেরার পর তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে প্রণাম করিলেন এবং অপার ভক্তি প্রকট করে নিজ অপরাধের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে কহিলেন - "হে ভগবান! আমার জ্ঞান হয়েছে, আপনিই রাঘবেন্দ্র শ্রীরামচন্দ্র। আপনার রোষেই সরিতাপতি(শ্রীসমুদ্রদেব) ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। রাবণ সপরিবার হত হয়ে লঙ্কা হতে দূর হয়ে গিয়েছিল। হে ভগবান! সেই আপনিই শ্রীকৃষ্ণ রূপে আগমন করেছেন। আমার উদ্দণ্ডতাকে ক্ষমা করুন। হে প্রভু! আমি সর্বথা আপনার ভৃত্য, আপনি বলুন আমার কি করণীয়।" ।।৭২-৭৪।।
জাম্ববানের বচন শ্রবণ করে জগদীশ্বর কহিলেন - "হে ঋক্ষরাজ! মণিপ্রাপ্তি হেতু আমার এই বিলে আগমন ঘটেছে।" ।।৭৫।।
এরপর ঋক্ষরাজ জাম্ববান প্রীতিসহিত তাঁর পূজা করে তাঁকে নিজ কন্যা জাম্ববতী এবং স্যমন্তকমণি দান করিলেন ।।৭৬।।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেবী জাম্ববতীকে পত্নীর সম্মান প্রদান করিলেন তথা মণি কণ্ঠে ধারণ করিলেন এবং ঋক্ষরাজের নিকট হইতে বিদাই অনুমতি গ্রহণ করে দ্বারকার প্রতি প্রস্থান করিলেন ।।৭৭।।
কথাসমাপ্তির দিবসে উদারবুদ্ধি বসুদেব ব্রাহ্মণদের ভোজন করিয়ে তাদের দক্ষিণার দ্বারা প্রসন্ন করিলেন ।।৭৮।।
বিপ্রগণ আশীর্বাদ করছিলেন ঠিক সেই সময় শ্রীহরি মণি ধারণ করে পত্নীসহিত সেথায় আগমন করিলেন ।।৭৯।।
ভার্যাসহিত শ্রীকৃষ্ণের আগমন দর্শন করে বসুদেব এবং পুরে আগমন করা ব্যক্তিগণেদের নেত্র হর্ষাশ্রুতে পূর্ণ হয়ে গেল তথা হৃদয়ে পরম আনন্দের আগমন ঘটিল ।।৮০।।
তদনন্তর দেবর্ষি নারদ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আগমনে হর্ষিত হয়ে বসুদেব ও শ্রীকৃষ্ণের নিকট হইতে বিদায় অনুমতি গ্রহণ করে ব্রহ্মসভায় গমন করিলেন ।।৮১।।
ভগবান শ্রীহরির এই চরিত্র যাহার কীর্তির দ্বারা অপযশ দূর হয়ে যায়। যে বিমল ভক্তিসহকারে ইহা পাঠ করে এবং শুদ্ধচিত্তে ইহা শ্ররণ করে সে সুখপূর্ণ হয়, জগতে সর্বদা তার কামনা সিদ্ধি হয় এবং অন্তে সে গমনাগমন হতে মুক্তির মার্গ লাভ করে ।।৮২।।
ইতি শ্রীস্কন্দপুরাণের মানসখণ্ডে শ্রীমদ্দেবীভাগবতমাহাত্যের দ্বীতিয়োধ্যায়
শ্রীমদ্দেবীভাগবত-মাহাত্য
দ্বীতিয়োধ্যায়
দেবীভাগবত মাহাত্য-প্রসঙ্গে জাম্ববানের নিকট হতে শ্রীকৃষ্ণের মণি প্রাপ্তি তথা জাম্ববতী সহিত বিবাহ করে দ্বারকায় পুনঃ আগমনের কথা
ঋষিগণ প্রশ্ন করিলেন -
হে মহাবুদ্ধিমান সূত! মহাভাগ বসুদেব কেমন করে পুত্রকে প্রাপ্ত করলেন? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পরিভ্রমণ করে প্রসেনকে কোথায় খুঁজেছিলেন এবং কি কারণে খুঁজেছিলেন? ।।১।।
শ্রীমদ্দেবীভাগবতের এই কথা বসুদেব কোন বিধির দ্বারা শ্রবণ করেছিলেন এবং এর বক্তা কে হয়েছিলেন? এসব বর্ণনা করার কৃপা করুন ।।২।।
ঋষি সূত কহিলেন -
ভোজবংশী রাজা সত্রাজিত দ্বারকায় সুখপূর্বক নিবাস করতেন। তিনি সদা সূর্যদেবের আরাধনা করতেন ।।৩।।
ভগবান সূর্যদেব সত্রাজিতের ভক্তিতে পরম প্রসন্ন হয়ে তাকে নিজ লোকের দর্শন করালেন ।।৪।।
তিনি তাকে 'স্যমন্তক' নামক মণি প্রদান করলেন। সত্রাজিত সেই মণি গলে ধারণ করে দ্বারকায় আসিলেন ।।৫।।
সেই মণি ছিল অত্যন্ত ভাস্বরযুক্ত। তাকে দর্শণ করে পুরবাসিরা ভাবিলেন ইনি সূর্যনারায়ণ। অতঃএব সভায় তিষ্ঠ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিকট গমন করে তাকে কহিলেন - 'হে জগতপ্রভু ! সূর্যনারায়ণ দেব পদার্পণ করিছেন'। তাদের কথা শ্রবণ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখমণ্ডল হাস্যে পরিণত হল ।।৬-৭।।
তিনি কহিলেন - 'হে বালকগণ! ইনি সূর্যনারায়ণ নয়। স্যমন্তকমণি ধারণ করে সত্রাজিত পদার্পণ করিছেন। এই মণির কারণেই তার এমন জ্যোতি। দেব সূর্যনারায়ণ তাহাকে এই মণি প্রদাণ করেছেন ।।৮।।
তদনন্তর বিপ্রগণকে ডেকে সত্রাজিত তাদের দ্বারা স্বস্তি-যাচন করালেন, মণির পূজা করিলেন এবং সেই মণিকে নিজ ভবনে স্থাপিত করিলেন ।।৯।।
প্রতিদিন আঠ ভার সুবর্ণ প্রদানকারী এই মণি যেই স্থানেই অবস্থিত থাকিত, সেথায় মহামারী, দুর্ভিক্ষ এবং অন্য উৎপাতসম্বন্ধী ভয় কদাপি থাকিত না ।।১০।।
সত্রাজিতের প্রসেন নামক এক ভ্রাতা ছিল। এক বার তিনি সেই মণিকে গলে ধারণ করে অশ্বোপরি তিষ্ঠ হয়ে শিকার করিতে বনে গমন করলেন। তাকে সিংহ দর্শণ করতেই অশ্বসহিত হত্যা করে মণি অধিকার করিল ।।১১-১২।।
ঋক্ষরাজ জাম্ববান সেথায় গমন করেছিলেন। তিনি দেখলেন, সিংহ মণি অধিকার করেছেন। অতঃএব বিলের দ্বারেই সিংহকে বধ করে তিনি সেই মণি অধিকার করলেন ।।১৩।।
তিনি সেটিকে নিজ পুত্রকে ক্রীড়ার্থে প্রদান করিলেন। তার পুত্র সেই ভাস্বরযুক্ত মণি গ্রহণ করে ক্রীড়া করিতে লাগিল ।।১৪।।
কিছু কালান্তরের পশ্চাৎও যখন প্রসেনের পুনঃআগমন ঘটিল না তখন সত্রাজিতের মহান দুঃখ হল। তিনি কহিলেন - 'কে জানে কার মণি প্রাপ্ত করার ইচ্ছা হল, কার হাথে প্রসেন কালের গ্রাস হয়ে গেল!' ।।১৫।।
এরপর জনসমাজের মুখে দ্বারকায় এই প্রকারের নিন্দা কথিত হল যে মণির প্রতি আসক্তির কারণে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রসেনকে বধ করেছে ।।১৬।।
এই কথা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রবণ করিলেন। তখন নিজের উপর এই মিথ্যা কলঙ্ককে দূর করিতে তিনি কিছু পুরবাসি সহিত যাত্রা প্রারম্ভ করিলেন ।।১৭।।
তিনি বনে গমন করিলেন। সেথায় সিংহদ্বারা হত প্রসেনকে দেখিলেন। রক্তদ্বারা চিহ্নিত মার্গে সিংহকে খুজতে তিনি অগ্রসর হলেন ।।১৮।।
একটি বিলের দ্বারে মৃত সিংহকে দেখিলেন। তখন তিনি পুরবাসিদের কৃপাবশত কহিলেন - 'তোমরা আমার পুনঃআগমন না হওয়া পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা কর। মণি হরণকারি ব্যক্তিকে খুজিতে আমি বিলে প্রবেশ করছি' ।।১৯-২০।।
যথাআজ্ঞা কহে পুরবাসী সেই স্থানেই তিষ্ট হলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিলের অন্দরে সেই স্থানে গমন করিলেন যেখানে জাম্ববানের নিবাস ছিল ।।২১।।
তিনি ঋক্ষরাজের বালককে মণি হস্তে দেখিলেন। তিনি মণি হরণ করার প্রচেষ্ঠা করিলেন। ইতিমধ্যেই ধাত্রী ভীষণ শব্দে গর্জনা প্রারম্ভ করিল ।।২২।।
ধাত্রির গর্জনা শ্রবণ করে সেই স্থানে শীঘ্রই জাম্ববানের আগমন ঘটিল। তার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সহিত যুদ্ধ প্রারম্ভ হয়ে গেল। অহর্নিশি সেই যুদ্ধ চলিল ।।২৩।।
সপ্তবিংশ দিবস পর্যন্ত তাদের মধ্যে ঘোর সংগ্রাম চলিল। অন্যদিকে দ্বারকাবাসী বিলের দ্বারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতীক্ষায় ছিল ।।২৪।।
দ্বাদশ দিবস তারা প্রতীক্ষা করিল। তৎপশ্চাৎ ভীত হয়ে তারা নিজ-নিজ গৃহে গমন করিল। সেথায় গমন করে তারা প্রারম্ভ হতে অন্ত পর্যন্ত সমস্ত কথা কহিলেন ।।২৫।।
সেই কথা শ্রবণ করে সবারই মহান কষ্ট হল। তারা তখন সত্রাজিতের নিন্দা করিতে লাগিল। নিজ পুত্রের এই কষ্টের কথা মহাভাগ বসুদেবের কর্ণেও প্রবেশ করিল ।।২৬।।
সপরিবার তিনি শোকসাগরে ওঠা-নামা করিতে লাগিলেন। 'এবার আমার কল্যাণ কিপ্রকারে হবে!' এমন অনেক চিন্তাই তার মনে উৎপন্ন হল ।।২৭।।
সেইকালেই ব্রহ্মলোক হতে দেবর্ষি নারদের সেথায় আগমন ঘটিল। বসুদেব উঠিয়া মুনিকে প্রণাম করিলেন। তার যথোচিত পূজা করিলেন ।।২৮।।
নারদমুনি বুদ্ধিমান বসুদেবের কুশল-সংবাদ নিলেন। এরপর তিনি প্রশ্ন করিলেন - 'হে যদুশ্রেষ্ঠ! আপনি কি কারণে চিন্তাগ্রস্থ?' ।।২৯।।
বসুদেব কহিলেন -
আমার প্রিয় পুত্র শ্রীকৃষ্ণ প্রসেনের সন্ধান করিতে পুরবাসিসহিত বনে গমন করেছিল। মৃত প্রসেনের উপর তার দৃষ্টি পরেছিল ।।৩০।।
বিলের দ্বারে প্রসেনের হত্যাকারী সিংহকে মৃত দেখিল। তখন পুরবাসিদের বিলের দ্বারেই অপেক্ষা করিয়ে সে স্বয়ং অন্দরে প্রবেস করিল ।।৩১।।
হে মুনি! বহু দিবস ব্যতীত হয়ে গিয়েছে, এখনও আমার সেই প্রাণপ্রিয় পুত্রের পুনঃআগমন হল না। এতেই আমি চিন্তিত। কৃপা করে এমন কোন উপায় বলুন যার দ্বারা আমার পুত্রের শীঘ্রই পুনঃআগমন ঘটে ।।৩২।।
দেবর্ষি নারদ কহিলেন -
হে যদুশ্রেষ্ঠ! আপনি পুত্রপ্রাপ্তির হেতু অম্বিকা দেবীর আরাধনা করুন। তার আরাধনার দ্বারাই আপনার শীঘ্র কল্যাণ হবে ।।৩৩।।
বসুদেব কহিলেন -
হে দেবর্ষি! সেই অম্বিকা দেবী কে? তার মহিমা কি এবং কি প্রকারে তার পূজা হয়? হে ভগবন! ইহা বলিবার কৃপা করুন ।।৩৪।।
দেবর্ষি নারদ কহিলেন -
হে মহাভাগ বসুদেব! দেবী অম্বিকার মাহাত্য অতুল্য। তার সম্পূর্ণ মাহাত্যকে বিস্তাররূপে কে বলতে পারে! আমি সংক্ষেপে কিছু বলছি তা শ্রবণ করুন ।।৩৫।।
ভগবতী অম্বিকা নিত্যা। তিনি সচ্চিদানন্দরূপিণী। তিনি সর্বোপরি। এই সম্পুর্ণ চরাচর জগতে তিনি ব্যাপ্ত ।।৩৬।।
তার আরাধনার প্রভাবেই জগতপিতা ব্রহ্মা এই চরাচর জগতের সৃজন করেন। মধু এবং কৈটভের দ্বারা ভয়ভীত হয়ে পিতামহ দেবীর স্তুতি করেছিলেন আর তার প্রসাদ রূপে সেই ভয় হতে মুক্ত হয়েছিলেন ।।৩৭।।
তারই কৃপায় ভগবান বিষ্ণু এই জগতের সংরক্ষণ করেন। ভগবান রুদ্র সংসারের সংহারকার্যে সফল তখনই হন যখন দেবী তার কৃপাদৃষ্টি নিরীক্ষণ করেন ।।৩৮।।
তিনিই এই সংসার বন্ধনের কারণ, আবার তিনিই মুক্তিপ্রদায়িনী। সেই দেবী পরম বিদ্যাস্বরূপিণী, তিনি সর্বেশ্বরেরও ঈশ্বরী ।।৩৯।।
আপনি নবরাত্র-বিধিতে সেই ভগবতী জগদম্বিকার পূজা করে নয় দিবসে শ্রীমদ্দেবীভাগবত পুরাণ শ্রবণ করুন ।।৪০।।
সেই পুরাণের শ্রবণ মাত্রই শীঘ্রই আপনার পুত্রের পুনঃআগমন ঘটিবে। যে এই পুরাণের পাঠ এবং শ্রবণ করে তার থেকে ভুক্তি-মুক্তি দূরে থাকিতে পারে না ।।৪১।।
এই কথা বলার পরে শ্রী বসুদেব নারদ মুনিকে মস্তক ঝুকিয়ে চরণে প্রণাম করিলেন এবং অপার প্রসন্নতা প্রকট করে কহিলেন ।।৪২।।
বসুদেব কহিলেন -
হে ভগবান! আপনার বাক্যের দ্বারা আমার ভগবতী জগদম্বিকার কৃপা-প্রসাদের দ্বারা সিদ্ধ নিজের পূর্বপ্রসঙ্গ স্মরন হল। সেই দেবীর মাহাত্য কথা আমি বলছি, আপনি শ্রবণ করুন ।।৪৩।।
পুরাতন কথা, আকাশবাণী দ্বারা জ্ঞাত হয়ে যে 'দেবকীর অষ্টম গর্ভের দ্বারাই কংসের নিধন হবে' সেই পাপী কংস ভয়ের কারণে আমাকে সভায় ঘিরে ধরেছিল ।।৪৪।।
নিজ ভার্যা দেবকীর সহিত আমাকে কারাগারে বাস করিতে হয়েছিল। যত বার আমার পুত্রের জন্ম হত ততবার পাপকর্মে লিপ্ত সেই কংস তাকে বধ করিত ।।৪৫।।
কংসের হস্তে আমার ছয় পুত্র নিহত হওয়ার কারণে দেবকী শোকে আকুল হয়ে গিয়েছেল। সেই দেবী রূপী নারী দিবস-রাত্রি কেবল চিন্তা করিত ।।৪৬।।
তখন আমি গর্গমুনিকে আহবান করে তার চরণে মস্তক নত করে তাকে পূজেছিলাম। তার কাছে দেবকীর দুঃখ কথা নিবেদন করে পুত্র প্রাপ্তির কামনা প্রকট করেছিলাম ।।৪৭।।
আমি বলেছিলাম - "হে ভগবান! আপনি করুণাসিন্ধু। আপনি যদুদের গুরু। হে মুনি! আপনি দীর্ঘজীবী পুত্র প্রাপ্তির সাধন বলিবার কৃপা করুন" ।।৪৮।।
তখন দয়ানিধি গর্গমুনি আমার দ্বারা প্রসন্ন হয়ে কহিলেন - হে মহাভাগ বসুদেব! দীর্ঘজীবী পুত্র প্রাপ্ত করিবার উপায় আমি বলছি, তুমি শ্রবণ কর ।।৪৯।।
সেই ভগবতী দুর্গা ভক্তদুর্গতিহারিণী। তুমি সেই কল্যাণী দেবীর আরাধনা কর। তার আরাধনার দ্বারাই তোমার শ্রেয় হবে ।।৫০।।
তার আরাধনার দ্বারাই সবার সর্বমনোকামনা পূর্ণ হয়। যার ভগবতী দুর্গার উপরে ভক্তি আছে তার কাছে জগতে কিছুই দুর্লভ নেই ।।৫১।।
মুনির এই বচনের পর আমাদের উভয়ের হৃদয়ে অপার হর্ষ হল। আমি অত্যন্ত ভক্তিপূর্বক ওনাকে প্রণাম করিলাম এবং জোরহস্তে কহিলাম ।।৫২।।
বসুদেব কহিলেন -
হে ভগবান! আপনি করুণানিধি। যদি আমার উপরে আপনার প্রীতি থাকে তবে মথুরাপুরীতেই আপনি আমার হেতু চণ্ডিকা দেবীর আরাধনা প্রারম্ভ করে দিন ।।৫৩।।
হে মহামতি! আমি কংসের গৃহে নিরুদ্ধ। আমার উৎসাহ থাকিলেও আমি কেমন করে করিব? অতএব আপনিই এই দুঃখরূপী দুস্তর সাগর হতে উদ্ধার করার কৃপা করুন ।।৫৪।।
এই প্রকার আমার কথার পর মুনিবর আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে কহিলেন - 'বসুদেব! তুমি আমার অতি প্রিয় পাত্র, অতএব তোমার হিত আমি অবশ্যই করিব' ।।৫৫।।
অতএব আমার প্রতি প্রীতির কারণে এবং আমার প্রেমপুর্বক প্রার্থনা করার পর গর্গমুনি দেবী দুর্গার আরাধনা করিবার জন্য ব্রাহ্মণ সহিত বিন্ধ্যপর্বতে গমন করিলেন ।।৫৬।।
সেথায় গমন করে তিনি জপ-পাঠে সংলগ্ন হয়ে ভক্তঅভীষ্টপ্রদায়িনী দেবী জগদ্ধাত্রীর আরাধনা করিতে লাগিলেন ।।৫৭।।
যথাকালে নিয়ম-অনুষ্ঠানের সমাপ্তির পর আকাশবাণী হল - "হে মুনিবর! আমি প্রসন্ন। তোমার কার্যসিদ্ধি অবশ্যই হবে।" ।।৫৮।।
ভুভারহরণার্থে আমি শ্রীহরিকে সংবাদ প্রেরণ করেছি। বসুদেবের নিকটে দেবকীর গর্ভ হতে তিনি তাঁর অংশাবতার গ্রহণ করিবেন ।।৫৯।।
কংসের ভয়ে ভীত হয়ে বসুদেব সেই বালককে প্রাপ্ত করে তাঁকে গোকুলে নন্দের গৃহে পৌছে দেবেন ।।৬০।।
তিনি যশোদার কন্যাকে স্বগৃহে আনিয়া কংসের হস্তে প্রদান করিবেন। কংসের হস্তে প্রদান করা মাত্রই কংস তাঁকে হত্যা করিতে ক্ষিতিতে নিক্ষেপ করিবে ।।৬১।।
তখনই সেই কন্যা তার হস্ত হতে নির্গমন করিবে এবং তাঁর দিব্য রূপ প্রকট হবে। আমারই অংশরূপ ধারণ করে সে বিন্ধ্যগিরিতে গমন করে জগত কল্যাণে সংলগ্ন হবে ।।৬২।।
এই প্রকার দেবীর বচন শ্রবণ করে গর্গমুনি জগদম্বিকাকে প্রণাম করিলেন। অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে তিনি মথুরাপুরীতে আগমন করিলেন ।।৬৩।।
গর্গআচার্যের মুখ হতে আমি মহাদেবীর বরদান শ্রবণ করিলাম। ভার্যাসহিত শ্রবণ করে আমার অত্যন্ত প্রীতি হল। আমার হৃদয়ে আনন্দ সমুদ্রের আগমন হল ।।৬৪।।
সেইকাল হতেই আমার দেবীর উত্তম মাহাত্যের জ্ঞান হয়েছিল। হে দেবর্ষি! এখনও আমি আপনার মুখারবিন্দ হতে সেই মাহাত্যই শ্রবণ করিতেছি ।।৬৫।।
অতএব হে প্রভু! আপনিই আমাকে দেবীভাগবত শোনাবার কৃপা করুন। হে দেবর্ষি! আপনি দয়ানিধি, আমার সৌভাগ্যের কারণেই আপনার এই স্থানে আগমন ঘটেছে ।।৬৬।।
বসুদেবের বচন শ্রবণ করে নারদের মনে প্রীতি হল। সুদিনে এবং শুভনক্ষত্রে তিনি কথা আরম্ভ করিলেন ।।৬৭।।
কথার নির্বিঘ্নে সমাপ্তির জন্য অনেক দ্বিজ নবার্ণ-জপ করিতে লাগিল এবং মার্কণ্ডেয়পুরাণে উক্ত দেবীর স্তব পাঠ করিতে লাগিল ।।৬৮।।
শ্রীনারদ প্রথম স্কন্ধ হতে কথা আরম্ভ করিলেন। বসুদেব ভাগবতামৃত ভক্তিপূর্বক শ্রবণ করিতে লাগিলেন ।।৬৯।।
নবম দিবসে কথার পূর্তি হবার পর মহামনা বসুদেব প্রসন্ন হয়ে পুস্তক এবং কথাবাচকের যথোচিত পূজা করিলেন ।।৭০।।
সেই কালে বিলে জাম্ববান সহিত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের যুদ্ধ চলছিল। কিছুকাল পশ্চাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুষ্টিপ্রহারের দ্বারা জাম্ববান আহত হল, তাঁর দেহ রক্তে জর্জরিত হল ।।৭১।।
স্মৃতি ফেরার পর তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে প্রণাম করিলেন এবং অপার ভক্তি প্রকট করে নিজ অপরাধের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে কহিলেন - "হে ভগবান! আমার জ্ঞান হয়েছে, আপনিই রাঘবেন্দ্র শ্রীরামচন্দ্র। আপনার রোষেই সরিতাপতি(শ্রীসমুদ্রদেব) ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। রাবণ সপরিবার হত হয়ে লঙ্কা হতে দূর হয়ে গিয়েছিল। হে ভগবান! সেই আপনিই শ্রীকৃষ্ণ রূপে আগমন করেছেন। আমার উদ্দণ্ডতাকে ক্ষমা করুন। হে প্রভু! আমি সর্বথা আপনার ভৃত্য, আপনি বলুন আমার কি করণীয়।" ।।৭২-৭৪।।
জাম্ববানের বচন শ্রবণ করে জগদীশ্বর কহিলেন - "হে ঋক্ষরাজ! মণিপ্রাপ্তি হেতু আমার এই বিলে আগমন ঘটেছে।" ।।৭৫।।
এরপর ঋক্ষরাজ জাম্ববান প্রীতিসহিত তাঁর পূজা করে তাঁকে নিজ কন্যা জাম্ববতী এবং স্যমন্তকমণি দান করিলেন ।।৭৬।।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেবী জাম্ববতীকে পত্নীর সম্মান প্রদান করিলেন তথা মণি কণ্ঠে ধারণ করিলেন এবং ঋক্ষরাজের নিকট হইতে বিদাই অনুমতি গ্রহণ করে দ্বারকার প্রতি প্রস্থান করিলেন ।।৭৭।।
কথাসমাপ্তির দিবসে উদারবুদ্ধি বসুদেব ব্রাহ্মণদের ভোজন করিয়ে তাদের দক্ষিণার দ্বারা প্রসন্ন করিলেন ।।৭৮।।
বিপ্রগণ আশীর্বাদ করছিলেন ঠিক সেই সময় শ্রীহরি মণি ধারণ করে পত্নীসহিত সেথায় আগমন করিলেন ।।৭৯।।
ভার্যাসহিত শ্রীকৃষ্ণের আগমন দর্শন করে বসুদেব এবং পুরে আগমন করা ব্যক্তিগণেদের নেত্র হর্ষাশ্রুতে পূর্ণ হয়ে গেল তথা হৃদয়ে পরম আনন্দের আগমন ঘটিল ।।৮০।।
তদনন্তর দেবর্ষি নারদ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আগমনে হর্ষিত হয়ে বসুদেব ও শ্রীকৃষ্ণের নিকট হইতে বিদায় অনুমতি গ্রহণ করে ব্রহ্মসভায় গমন করিলেন ।।৮১।।
ভগবান শ্রীহরির এই চরিত্র যাহার কীর্তির দ্বারা অপযশ দূর হয়ে যায়। যে বিমল ভক্তিসহকারে ইহা পাঠ করে এবং শুদ্ধচিত্তে ইহা শ্ররণ করে সে সুখপূর্ণ হয়, জগতে সর্বদা তার কামনা সিদ্ধি হয় এবং অন্তে সে গমনাগমন হতে মুক্তির মার্গ লাভ করে ।।৮২।।
ইতি শ্রীস্কন্দপুরাণের মানসখণ্ডে শ্রীমদ্দেবীভাগবতমাহাত্যের দ্বীতিয়োধ্যায়
Subscribe to:
Posts (Atom)